মারিয়াম তোমাকে ভুলবো না

মারিয়াম তোমাকে ভুলবো না

January 9, 2018

গনিতবিদ্যায় পৃথিবীতে নোবেল পুরস্কার নেই।যে শিরোপাকে ‘গনিতের নোবেল’ বলা হয় তার নাম ‘ফিল্ডস পদক’।মোট ৬১জন গনিতবিদ ফিল্ডস পদক পেয়েছেন। পৃথিবীর কুড়িখানা দেশের নাগরিক এই পদক পেয়েছেন।হিসেবটা এরকম ঃ আমেরিকা ১৩,ফ্রান্স ১২,রাশিয়া ৮,ব্রিটেন ৬,জার্মানি ৪,জাপান ৩,বেলজিয়াম ২, নরওয়ে,সুইদেন,ফিনল্যান্ড,ইজরায়েল,ইরান,অস্ত্রিয়া,সুইজারল্যান্ড,অস্ট্রেলিয়া,ইউক্রেন,নিউ জিল্যান্ড,চিন,ব্রাজিল ও ভিয়েতনাম একটি করে ‘ফিল্ডস পদক’ পেয়েছে। তোমরা যারা এই বিষয়ে খবর রাখ জিগ্যেস করতে পার,ভারতের মঞ্জুল ভারগাবের কথা লিখিনি কেন? কেমন করে লিখব? বাবা-মা ভারতীয় হলেও মঞ্জুলের জন্ম তো কানাডায়। পরে আমেরিকার নাগরিক হয়েছেন। উইকিপিডিয়ায় লেখা,তিনি কানাডা ও আমেরিকা এই দুই দেশের নাগরিক ছিলেন।তাঁর কথা লিখতে গেলে ভারতের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের কথা নিশ্চয়ই বলব। মঞ্জুল খুব ভাল তবলা বাজান। জাকির হুসেনের কাছে তবলা শিখেছেন। দাদুর কাছে সংস্কত শিখেছেন।কিন্তু তিনি ‘ভারতীয়’ পরিচয়ে  ‘ফিল্ডস পদক’ পাননি। নোবেল পুরস্কারে যেমন অনেক টাকা, ফিল্ডস পদকের বেলায় তার পরিমান অনেক কম। কানাডার ডলারে পনেরো হাজার মাত্র। কানাডার ডলার বলছি কেন? কানাডার গণিতজ্ঞ জন চার্লস  ফিল্ডস (১৮৬৩-১৯৩২)-এর নামে এই পদক দেওয়া হয়। টাকা দিয়ে পৃথিবীতে আজও সব পুরস্কারের দাম বিচার হয় না। ১৯৩৬ সালে প্রথম একজনকে এই পদক দেওয়া হল। তারপর আনেক্কাল বাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এর আস্থিরতায় নোবেল পুরস্কারও কয়েকবছর দেওয়া হয়নি। ১৯৫০ সাল থেকে আবার ফিল্ডস পদক চালু হল। দুটো নিয়ম হয়েছিল তখন। যাকে এই পদক দেওয়া হবে তাঁর বয়স হবে চল্লিশের কম। প্রতি চার বছর পরপর এই পুরস্কার দেওয়া হবে। তাহলে একষটটিজন পুরস্কার পেলেন কেমন করে? প্রতিবছর এক থেকে চারজন এই পদক পেতেন।

আট দশকের পুরনো এই পদকের ইতিহাসে যারা যারা পদক জয়ী হয়েছেন সকলে বেঁচে নেই। সকলের বেঁচে থাকার কথাও তো নয়। প্রতেকেই পরিণত বয়সে শেষ বিদায় নিয়েছেন। দুটো ঘটনা রয়েছে বলার মতন।

এক—রুশ বিজ্ঞানী গ্রিগরি পেরেলমান এই পুরস্কার গ্রহন করতে রাজি হননি।                 ২০০৬ সালে তাঁর নাম এই পুরস্কারের জন্য  বিবেচিত হয়। এক অদ্ভুত মানুষ তিনি। ১৯৬৬ সালে জন্ম। বয়স ৫০ পার হয়েছে। ১৯৯১ সালে সেন্ট পিটারসবাগ ম্যাথামেটিক্যাল সোসাইটি তাঁকে পুরস্কার দিয়েছিল। সেই পুরস্কার তিনি নিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে ইউরোপিয়ান কংগ্রেস অফ  ম্যাথামেটিকস তাঁকে  পুরস্কার জয়ী ঘোষণা করে। তিনি বললেন,এই  পুরস্কার নেবেন না। ২০০৬ সালে ‘ফিল্ডস পদক’ ফিরিয়ে দিলেন। এক জটিল গানিতিক সমাধান বের করেছিলেন পেরেলমান। ২০১০ সালে তাই তাঁর নাম ‘মিলেনিয়াম পুরস্কার’-এর জন্য মনোনীত হল। ১০লক্ষ মার্কিন ডলার পুরস্কার। তাঁকে খবরটা দিতেই এই পুরস্কারও তিনি ফিরিয়ে দিলেন। আজও সমাধান হয়নি এমন সাতখানা বিষয়ের যে কোন একটি সমাধা করতে পারলেই এই পুরস্কার মিলবে। ছ’খানা আজও একিরকম ভাবে রয়েছে। কোনো  সমাধান হয়নি। মাত্র একটি সমাধান হয়েছে। তা হয়েছে পেরেলমানের হাতে। বড় জটিল সেই অঙ্ক।

 

দুই : যা আমাদের খুব বিস্মিত করে ,১৯৩৬ সাল থেকে সুরু হলেও পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো মহিলা গণিতবিদ এই পুরস্কার বহুকাল পাননি। কেবল মাত্র একজন ইরান দেশের মহিলা ২০১৪ সালে ‘ফিল্ডস পদক’ পেয়েছেন। সে বছর পৃথিবী জুড়ে এক বড়ো রকমের আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। ‘ফিল্ডস পদক’ জয়ী একমাত্র মহিলার কথা জানতে দেশে দেশে আগ্রহ বাড়তে থাকল। ২০১৭ সালের ১৪ই জুলাই এক গভীর দুঃসংবাদ পৌঁছে গেল সকল দেশে। ‘ফিল্ডস পদক’ জয়ী একমাত্র মহিলা গণিতজ্ঞা মারিয়াম মির্জাখানি(১৯৭৭-২০১৭)মাত্র চল্লিস বছর বয়েসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চিরকালের মত চলে গেলেন।

খুব অল্প বয়সে ক্যান্সারে চলে যাবার কথা বলতে গেলে বিজ্ঞান জগতের আর দুই মহিলা বিজ্ঞানীর কথা আমাদের মনে পরে।একজনের নাম রোজালিণ্ড ফ্র্যাংকলিন(১৯২০-১৯৫৮)। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী উইলিয়াম উইলকিনস–এর গবেষণাগারে রোজালিণ্ড কাজ করতেন। ডি এন এ-র এক্স-রে ছবি তোলায় সে সময় তাঁর মতো বিশেষজ্ঞ খুব কম ছিল। তাঁর সহযোগিতা না পেলে ওয়াটসন ও ক্রিক ডি এন এ-র গঠন সে সময় বলতে পারতেন কী না তা নিয়ে আজও আলোচনা হয়।

রোজালিণ্ড-এর পর যার কথা বলব তিনি রাচেল কারসন(১৯০৭-১৯৬৪)। তুলনায় খানিকটা বেশিদিন বেঁচে ছিলেন তিনি। সাতান্ন বছর। এক কথায় তাঁকে ‘সমুদ্র বিজ্ঞানী’ বলা যায়।তবে তাঁর বড় পরিচয়,তাঁর লেখা একটি বই,যা পৃথিবীতে সেসময় হইচই ফেলে দিয়েছিল। বইটির নাম ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’। বাংলায় ‘নীরব বসন্ত’। ডিডিটি-র মতো মারণবিষ পৃথিবীর কি সর্বনাশ করেছে এই নিয়ে তাঁর বই। এই কথা লিখেছিলেন বলে তাঁকে নানাভাবে আক্রমন করা হয়। তিনি নাকি ‘মিথ্যে’ বলেছেন! একটুও দমেননি রাচেল। সত্যি বলতে কী,১৯৬২ সালে বইটি বেরনর পর অনেক ঝর তাঁর অপর দিয়ে গিয়েছে। একটা বড়ো কাজ করে যেতে পেরেছিলেন তিনি। পরিবেশ নিয়ে মার্কিন সরকারকে ভাবাতে পেরেছিলেন তিনি। রাচেল সত্যি বলছেন না মিথ্যে বলছেন তা তদন্ত করে দেখার জন্য সদ্য নোবেল পুরস্কার জয়ী জে ভি ওয়াটসনকে সভাপতি করে একটা কমিটি হয়েছিল। রায় শেষ পর্যন্ত রাচেলের পক্ষেই গিয়েছে।

কেন জানিনা মারিয়াম মির্জাখানির কথা তোমাদের কাছে বলতে গিয়ে ওই দুজনের কথাও মনে পড়ে গেল। মারিয়ামের কথায় এবার যাই আমরা।

ইরানের রাজধানি শহর তেহরানে মারিয়াম ১৯৭৭ সালের ৩রা মে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ছোটোবেলা থেকেই নানা রকমের বই পরতে ভালবাসতেন মারিয়াম। ইরান ও ইরাক তখন নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছে। যুদ্ধের সময় দেশের সবকিছু গণ্ডগোল পাকিয়ে যায়। স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ। সেখানে মিলিটারিরা থাকে। আশ্রয় শিবির তৈরি হয়। যুদ্ধ শেষ হল একসময়। মারিয়াম মিডিল স্কুলে যেতে শুরু করলেন। নিয়মিত যাচ্ছিলেন স্কুলে। ফলও ভালই হচ্ছিল। তবে তিনি বইয়ের পোকা। হাতের কাছে যা পেতেন তাই পড়তেন। ইচ্ছে ছিল লেখিকা হবেন,উপন্যাস লিখবেন। উপন্যাস পড়তেন খুব। স্কুলে পড়ার সময় কখনও ভাবেননি,গনিতের ভুবনে ঠিকানা গড়বেন তিনি। চার ভাইবোন ছিল। বাবা-মা চাইতেন সকলে লেখাপড়া করুক। কেমন করে টাকা পয়সা রোজগার বেশি হবে,কখনও ভাবতে বলতেন না। বাড়িতে মারিয়ামের দাদা ছিলেন একজন। দাদা তাঁর এই ছোটো বোনকে অঙ্ক ও বিজ্ঞানের নানা মজার কথা বলতেন। সেই থেকে একটু একটু করে ওই দিকে তাঁর মন যেতে থাকে। একটি দিনের ঘটনা মারিয়ামের খুব মনে পরে,দাদা কোন একটা ম্যাগাজিন পড়ে এসে গল্পটা তাঁকে শুনিয়েছেন। গাউস নামে একজন খুব বড় জার্মান গণিতবিদ আছেন। কার্ল ফ্রিডরিখ গাউস। তাঁর ছোটোবেলার গল্প।

ক্লাসে গিয়েছেন গাউস। অঙ্কের মাস্টারমশাই ছেলেদের ‘১’ থেকে ‘১০০’ পর্যন্ত যোগ করতে বললেন। মাস্টারমশাই এই ফাঁকে খানিকটা ঘুমিয়ে নেবেন। ঘুমোবার জো রইলনা। এক ছেলে এসে ডাকাডাকি করছে,স্যার,অঙ্কটা করে ফেলেছি।

বিশ্বাস-ই হয়না মাস্টারমশাই-এর। ‘১’ থেকে ‘১০০’ পরপর লিখে যোগ করা অত সহজ কথা নাকি ! ছেলের খাতা দেখে তিনি অবাক,সে লিখেছে,’১’ থেকে ‘n’ পর্যন্ত যে কোণো সংখ্যার যোগফল হলঃ n(n+১)/2

‘n’ এর বদলে ‘১০০’ বসলে যোগফল হচ্ছে ১০০(১০০+১)/২। মানে ৫০৫০।

‘১’ থেকে ‘১০০’ পরপর যোগ করে দেখো, উত্তর কত পাওয়া যায়।

দাদার কাছে এই গল্প শুনে মারিয়াম খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন । বড়ো হয়ে মারিয়াম বলেছেন,অত সুন্দর সমাধান, আমার মাথায় আসেনি।

স্কুলের কাছেই ছিল বইয়ের দোকান।মারিয়াম একটু সময় পেলেই বইয়ের দোকানে ঢুকে পড়তেন। বই বাছাই করার সময় থাকত না। হাতের কাছে যা পেতেন নিয়ে আসতেন ।অংক বই চোখে পরলে নিয়ে আসতে ভুলতেন না । স্কুলে অংকের যে অলিম্পিয়াড হতো সেখানে যোগ দিলেন তিনি। ১৯৯৪ সালে সোনা জিতলেন।পরের বছর আবার সোনা জিতলেন।

স্কুল থেকে বেরিয়ে মারিয়াম তেহরানের শরিফ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।১৯৬৬ সালের বিশ্ববিদ্যালয়।খুব নামডাক এর।  একে ‘ইরানের এম আই টি’ বলা হয়। এম আই টি’র পুরো নাম জান তো? ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি ,আমেরিকার বিশ্বসেরা এক বিশ্ববিদ্যালয়।তেহরানের শরিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদেশের সেরা ছেলেমেয়েরাই পড়ার সুযোগ পায়। ২০১৪ সালে বলা হয়েছিল ৫০ বছরের কম এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এশিয়ায় ষষ্ঠ ও পৃথিবীতে ২৭ তম। উইকিপিডিয়ায়  বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সতীর্থ তালিকা রয়েছে সেখানে প্রথম নামটিই  রয়েছে মারিয়াম মির্জাখনির। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রিতে খুব ভাল ফল করেন মারিয়াম। সেসময় গণিতে খ্যাতিলাভ করেছেন এমন অনেক মাস্টারমশায়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।১৯৯৯ সালে গণিত বিদ্যায় বি.এসসি ডিগ্রি করেন মারিয়াম।তারপর আমেরিকার বিখ্যাত হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ২০০৪ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি করেন। যে কথা লিখতে খুব ভালো লাগছে, যাঁর কাছে ডক্টরেট ডিগ্রি করেছেন মারিয়াম, তিনিও একজন ‘ফিল্ডস পদক’ জয়ী।তাঁর নাম কুর্টিস টি মাকমুলেন।বয়স এখন তাঁর ঊনষাট।১৯৯৮ সালে ফিল্ডস পদক’ পেয়েছেন মাকমুলেন।প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকাল পড়িয়ে তিনি ১৯৯০ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ দেন।১৯৯৭ সাল থেকে হার্ভাডে  অধ্যাপনা করছেন।

সাংবাদিক বু’রা একবার মারিয়ামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইরান ও আমেরিকার গণিত শিক্ষার ভেতর ফারাক কেমন? উত্তরে মারিয়াম জানান, এ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা বেশি নেই। আমেরিকার হাইস্কুলে পড়েননি। তাই সেখানকার অংকের মান কেমন বলতে পারবেন না। তাছাড়া আমেরিকার এক- দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এ বিষয়ে কিছু বলা যায় না। তবে ইরানের লেখাপড়া এখানকার মতো নয়।ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মেয়েকে পড়তে গিয়ে সেসময়ে অনুমতি নিতে হয়েছে।সেখানে ছেলেদের ভিন্ন। মেয়েদের স্কুল ভিন্ন। তবে, অলিম্পিয়াড বা সামার ক্যাম্পে যোগ দিতে কোনো বাধা নেই। ইরানে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাইলে জাতীয় স্তরের ভর্তি পরীক্ষায় বসে পাশ করতে হবে।

ইরানের পড়ার সময় মারিয়াম বীজগণিত খুব ভালো শিখেছিলেন। হার্ভাডে ভর্তি হয়ে বুঝতে পারেন,কত কি শেখা বাকি আছে। হতাশ হননি।ভয়ও পাননি। ক্লাস নিতেন অধ্যাপক ম্যাকমুলেন সেমিনার ক্লাস নিতেন। মারিয়াম সেখানে নিয়মিত যেতেন। মারিয়াম শুরুতে একটি বর্ণ বুঝতে পারতেন না। তবে ধীরে ধীরে পরার ধরন ভালো লেগেছে। যখন মনে হতো তার যে একটু বুঝতে পারছেন,  প্রশ্নবানে মাস্টারমশাইকে জর্জরিত করে তুলতেন। প্রশ্ন ও উত্তর এর ভেতর থেকে কাজ করার নতুন নতুন বিষয় পাওয়া যেত। কথায় কথায় বলতেন মারিয়াম,ম্যাকমুলেনের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই।আক্ষেপ করতেন , কেন তাঁর কাছ থেকে আরও বেশি কিছু শেখা হল না।ডিগ্রি হল ,কত কি শেখা   হলো না।

২০০৪ সালের ডক্টরেট ডিগ্রি হয়ে যাওয়ার পর মারিয়াম ‘ক্লে মাথামেটিকস ইনস্টিটিউটের’ গবেষক পদে যোগ দেন। কিছুদিন পর প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ২০০৮ সালে চাকরি ছেড়ে পৃথিবীর অন্যতম সেরা ‘স্ট্যানফোর্ড’ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান মারিয়াম। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি স্ট্যানফোর্ড-এই ছিলেন।’স্ট্যানফোর্ড’-এর এক গণিতের অধ্যাপক তার স্বামী। একমাত্র মেয়ে আনাহিতা ও স্বামীকে রেখে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন।স্বামী,  কন্যা নয় শুধু, পৃথিবীর গণিত জগৎ তাকে হারিয়ে শোকাহত হয়েছে। জন্মভূমির নাগরিকত্ব ছেড়ে মারিয়াম মার্কিন দেশের নাগরিক হননি।

গণিতের জগতে মারিয়ামের একটার নাম ছিল। ‘মাস্টার অফ কার্ড সারফেস’ । বক্রতলের শিক্ষক। নাম থেকেই বোঝা যায়, বক্রতল নিয়ে কাজ করতেন তিনি।সেই বক্রতল কেমন? পরাবৃত্তীয় । ইংরেজিতে বলা হয় হাইপারবোলিক। মেঝেতে লম্বা কাগজ ফেলে উবু হয়ে বসে মা বক্রতল আঁকতেন। ছোট মেয়ে বলতো তখন, মা ছবি আঁকছে।

তোমরা অনেকেই জান , প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন।গণিত ও পদার্থবিদ্যা গবেষণায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জগৎজোড়া নামডাক।

মারিয়াম পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বলেছেন, মারিয়াম শুধু যে গণিতের নানা আসমাধেও সংকট সমাধান করেছেন তাই নয়, তিনি এমন কতগুলো উপায় তৈরি করেছেন যাদের বাদ দিয়ে অনেক বিষয়ে  কাজে হাত দেওয়ার কথা ভাবাই যায় না।বিলিয়ার্ড বল  যেমন একটা চারকোনা টেবিলে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে এদিক-ওদিক যায়, কেউই বলতে পারে না কখন কি হবে ,  মারিয়াম তার অঙ্ক দিয়ে সে কথা বলতে পারতেন। জ্যামিতি আর চলনবিদ্যার নিপুন মিশল জানতেন তিনি।কথাটা খুব সহজে আমরা লিখে দিলাম, আসল কাজ অনেক জটিল, অনেক কষ্টসাধ্য।পৃথিবীতে খুব বেশি গণিতবিদ এ কাজ জানেন না।গবেষণাপত্র তিনি খুব বেশি লেখেননি। প্রয়োজন কী ? যে কটা লিখেছেন, সংখ্যা আর জ্যামিতির প্রাণস্পর্শ করেছেন। সেই প্রাণের উচ্ছ্বাস গণিতের দুকূল ঝাপিয়ে  ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে চলেছে। মারিয়াম আমরা তোমাকে কখনও ভুলবো না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *