কৌরবদের যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য চাই দিব্যাস্ত্র। যুধিষ্ঠির অর্জুনকে আদেশ দিলেন- তুমি স্বর্গে যাও এবং দেবরাজ ইন্দ্রের কাছ থেকে দিব্যাস্ত্র সংগ্রহ করো।
অর্জুন ইন্দ্রের পুত্র, সুতরাং দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে দিব্যাস্ত্র দাবী করার অধিকার তাঁর সবচেয়ে বেশি। যুধিষ্ঠিরের আদেশ পাওয়া মাত্র অর্জুন ক্রমাগত উত্ত্রাভিমুখে যাত্রা করলেন। হিমাচলের ইন্দ্রনীল পর্বতে উপস্থিত হলেন। সেখানেই তিনি ইন্দ্রের দর্শন পেলেন। অর্জুন করজোড়ে বিনীত-ভাবে নিবেদন করলেন, ইন্দ্র যেন দয়া করে তাঁকে দিব্যাস্ত্র দান করেন ও অস্ত্রের ব্যবহারও শিখিয়ে দেন। কিন্তু ইন্দ্র দিব্যাস্ত্র দানের অধিকারী ছিলেন না। তিনি অর্জুনকে বললেন, দেবাদিদেব মহাদেবের অনুমতি ছাড়া তোমাকে আমি দিব্যাস্ত্র দিতে পারব না। অর্জুন, তুমি তপস্যার দ্বারা মহাদেবকে সন্তুষ্ট করো।
অর্জুন ঘোর তপস্যা শুরু করলেন। দেবাদিদেব মহাদেব অর্জুনকে পরীক্ষা করার জন্যে উমাকে নিয়ে কিরাত ও কিরাতিনীর রূপে তাঁকে দর্শন দিলেন। কিন্তু অর্জুন মহাদেবকে চিনতে পারলেন না। এক দানব বরাহরূপ ধরে অর্জুনের সামনে এল, অর্জুন তাঁকে বধ করার জন্যে তীর মারলেন। দানবটি প্রাণত্যাগ করল। থিক সেই সময় সেই কিরাত ও কিরাতিনী এসে দাবি করল ঐ বরাহকে তারাই মেরেছে। প্রথমে তর্ক, পরে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হল। কিন্তু শীঘ্রই অর্জুন বুঝতে পারলেন ঐ কিরাত ও কিরাতিনী আর কেউ নন, স্বয়ং শঙ্কর ও উমা। তৎক্ষণাৎ পার্থ জানু দ্বারা ভূমি স্পর্শ করে ভক্তিগদগদ কণ্ঠে তাঁদের ভজনা করতে লাগলেন। বারবার তাঁদের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগলেন। মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে পাশুপত অস্ত্র পার্থকে প্রদান করলেন এবং স্বর্গে গমন করার আদেশ দিলেন।
মহাদেবের আদেশে ইন্দ্র অর্জুনকে দিব্যাস্ত্র দিলেন। ইন্দ্রের আদেশে সারথি মাতলি দশসহস্র অস্বযোজিত বায়ুবেগ গতিসম্পন্ন মায়াময় রক্ষে করে অর্জুনকে স্বর্গে নিয়ে গেল। অর্জুন মুগ্ধ বিষ্যে দেখলেন স্বপ্নের ইন্দ্রপুরী অম্রাবতী। সুরলোকের পরম সৌন্দর্যময় আবাসস্থল।দ্বারদেশে চতুর্দন্দ ঐরাবত দাঁড়িয়ে। চতুর্দিক থেকে ভেসে আসছে পুস্পের সুগন্ধ। অসঙ্খ দেববিমান আসাযাওয়া করছে। অমরাবতীতে প্রবেশ করলেন অর্জুন। পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল শঙ্খ, বহুবিধ মনোরম বাদ্য দ্বারা তাঁদের অভ্যর্থনা জানানো হল। দেবতাদের দ্বার পরিবেষ্টিত হয়ে করলেন ইন্দ্র। এগিয়ে এলেন অর্জুন ইন্দ্রের কাছে, বক্ষলগ্ন করে প্রীতমনে সঙ্গে
জড়িয়ে ধরলেন ইন্দ্র। পুত্রের মনোরঞ্জনের জন্য নামগান ও নৃত্যের আয়োজন করেছিলেন দেবরাজ। দেবনর্তকীগন- উর্বশী, রম্ভা, চিত্রসেনা, চিত্রলেখা নৃত্যগীত বাদ্যের দ্বারা অর্জুনের মনোরঞ্জন করতে লাগলো। উর্বশীর সৌন্দর্য, তার রূপমাধুর্য, নৃত্যের কুশলতা অর্জুনকে মুগ্ধ করল। তিনি বারবার তার দিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন। সে দৃষ্টি ছিল এক অসামান্য কলাকুশলীর প্রতি এক ভক্তের শ্রদ্ধার দৃষ্টি। কিন্তু উর্বশী সে দৃষ্টির অন্য অর্থ করল।
পিতৃগৃহে কেটে গেল পাঁচটি বছর। অর্জুন নৃত্যগীত-বাদ্য শিক্ষা নিলেন। এছাড়াও দিব্যাস্ত্র প্রয়োগের শিক্ষাও গ্রহণ করলেন।
ইন্দ্রের কানে এলো, অর্জুন উর্বশীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। ইন্দ্র চিত্রসেনকে আদেশ দিলেন- অর্জুনের কাছে পাঠিয়ে দাও উর্বশীকে। উর্বশী শুনলো তার রূপে নাকি অর্জুন আকৃষ্ট হয়েছেন। এই সংবাদটি শোনামাত্র উর্বশী উন্মাদ হয়ে উঠল অর্জুনের প্রেমে। অর্জুনের কাছে যাবার কথা বলামাত্র উর্বশী নিজেকে মনোরম করে সাজাতে শুরু করল। সারাদিন ধরে নিজেকে সে মনোলোভা করে তুলল। সন্ধ্যা হতে না হতেই উর্বশী তার অসামান্য রূপের ডালি সাজিয়ে চলল অর্জুনের কাছে অভিসারে। মনে অদম্য কামনা, চোখে স্বপ্ন।
উর্বশীর আগমনবার্তা দ্বারপাল অর্জুনের কাছে পৌঁছে দিল। অর্জুন আদেশ দিলেন উর্বশীকে সসম্মানে নিয়ে আসা হয় যেন। উর্বশী এল। তাকে দর্শনমাত্র অর্জুন লজ্জাঅবনত মস্তকে অভিবাদন করলেন। বললেন, হে অপ্সরাশ্রেষ্ঠা, আমি আপনার ভৃত্যস্বরূপ। কি প্রয়োজনে আপনার আগমন দয়া করে নিবেদন করুন।
হতবাক স্তব্ধ উর্বশী। এ কি শুনছে সে? নিজের কানকে যে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। অর্জুন এ কি বলছেন? তাকে গুরুর নেয় সম্মান দেখাচ্ছেন, এও কি সম্ভব?
উর্বশী বিহ্বল চিত্তে বলল নৃত্যগীত উৎসবের সময় আপনি বারবার আমার দিকে দৃষ্টিপাত করছিলেন। আপনার ওই দৃষ্টি আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। তাই আপনার পিতা দেবরাজের আদেশে আমি আপনার সঙ্গে মিলন-সুখ কামনায় এসেছি। হে অরিন্দম আপনি যে আমার চিরবাঞ্ছিত। দয়া করে আমাকে এ সুখ থেকে বঞ্চিত করবেন না।
উর্বশীর কথা অর্জুনের কানে যেন বিষ ঢেলে দিল। লজ্জিত অর্জন দু'হাত দিয়ে দুই কান চেপে ধরলেন। বললেন- এ আপনি কি বলছেন। আপনি যে আমার গুরুপত্নী। এমন কথা শ্রবণেও যে আমার মহাপাপ। জননী কুন্তি ও দেবী ইন্দ্রানীর মত আপনিও যে আমার নমস্যা, আমার পরমপূজ্যা। আমার ওই একাগ্র দৃষ্টিপাতে কোনো অভিসন্ধি ছিল না। আমি তো কেবলমাত্র মুগ্ধ দৃষ্টিতে পৌরবংশের জননীরূপে আপনাকে দেখছিলাম। মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠছিলাম এই ভেবে যে পৌরবংশ আপনার থেকেই উৎপন্ন। আপনার তো অজানা নয় যে পুরুরবা ও আপনার গর্ভজাত পুত্র হলেন আয়ু। তার পুত্র নহুষ। এবং নহুষের পৌত্রই হলেন পুরু। সেজন্য আপনি তো আমাদের সকলের পরমগুরু। আপনারা দেবলোকের অধিবাসী। আপনাদের বয়স বৃদ্ধি হয় না। তাই আপনি আজও যৌবনবতী সুন্দরী, মনোলোভা, কিন্তু তাই বলে তো সত্যকে অস্বীকার করা যায় না।
উর্বশী বলল আমরা দেবলোকের নর্তকী। সামান্যা নারী। পুরুবংশের পুত্র-পৌত্ররা মৃত্যুর পর স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করে আমার সঙ্গে ক্রীড়া-কৌতুকে কালযাপন করছে। তাদের কাছে আমি এক নারী। তারা আমাকে গুরুপত্নী বলে মনে করে না। সুতরাং আপনিও পূর্বকথা বিস্মৃত হয়ে আমাকে গ্রহণ করে তৃপ্ত করুন।
অর্জুন বললেন আমি আপনার চরনে নতধিক হয়ে প্রণাম জানাচ্ছি আপনি। আমার মাতৃবৃৎ, আমি আপনার পুত্ররূপ। দয়া করে আপনি আপনার স্বস্থানে প্রত্যাগমন করুন।
অর্জুন মাথা নত করলেন। ক্রোধে উর্বশীর সমস্ত শরীর কম্পিত হতে লাগল। তার প্রেমবাঞ্চিত নেত্র ক্রোধে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হতে লাগল। অগ্নিমূর্তিরূপিনী উর্বশীঅভিশাপ দিল, হে পার্থ, তোমার পিতার আদেশে আমি অভিসারিকা হয়েছিলাম। তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করে অপমানিত করলে, তাই আমি অভিশাপ দিচ্ছি তুমিও মানহীন ও ক্লীব হয়ে স্ত্রীগণের মধ্যে নৃত্য করে কালযাপন করবে।
অর্জুন অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। বীনা দোষে এইরকম শাস্তি তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না।
কথাটা কানে গেল। সব শুনে তিনি অর্জুনকে একান্তে ডেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, পুত্র তুমি আমাকে ধন্য করেছ। ধন্য তোমার মা কুন্তি দেবী। তোমার মত এমন সন্তানকে তিনি গর্ভে ধারণ করে ধন্য হয়েছেন। ধৈর্য ও সংযমের গুণে তুমি আজ ঋষিদেরও হার মানালে। তাই উর্বশীর এই অভিশাপ তোমার কাছে আশীর্বাদ হয়ে আসবে। বারো বছর বনবাসের পর যখন ত্রয়োদশ বছরে পড়বে তখন তোমাকে অজ্ঞাতবাসে থাকতে হবে। তখন তুমি ক্লীবরূপে নর্তকেল বেশে নিরাপদে কালযাপন করতে পারবে। তার একবছর পরে তুমি আবার অভিশাপ মুক্ত হবে, পুরুষত্ব প্রাপ্ত হবে।
ইন্দ্রের কথায় অর্জুন অত্যন্ত শান্তিলাভ করলেন। স্বর্গভবনে সুখে কালযাপন করতে লাগলেন।[:]