Menu

Min. Order value - INR 300 Delivery Charges Within Kolkata - Free In WB (outside Kol)- INR 75 EZ( Ori, Bih, Jhar) - INR 100 Others In India - INR 150 Outside India - on actuals

[:bn]আনন্দ নিকেতন[:]

March 15, 2018
[:bn](বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত স্মৃতি-সাহিত্য প্রতিযোগিতায় ২য় পুরস্কৃত গল্প ) প্রাথমিকে শিক্ষকতার পাশাপাশি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাতেও হাত পাকিয়েছেন প্রশান্তবাবু। দাতব্য চিকিৎসালয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা করে আসছেন। চিকিৎসক হিসাবে তাঁর সুখ্যাতি অনেক দূর অবধি ছড়িয়ে পড়েছে। স্কুলে কর্মরত অবস্থায় কোন ছাত্র বা ছাত্রীর শরীর খারাপ হলে বা কেউ পড়ে গিয়ে হাত -পা কাটলে কিংবা ব্যথা পেলে প্রশান্ত বাবুর ডাক পড়বেই । স্কুলের প্রধান শিক্ষক অনেকটাই ভরসা করেন ওনাকে। অবশ্য এ নিয়ে সহধর্মিনী কোন কোন দিন উষ্মা প্রকাশ করেন। কিন্তু প্ৰশান্তবাবু বলেন, ওরা দুর্বল। পিছিয়ে থাকা ছেলেমেয়ে। ওদেরকে তো একটু দেখতেই হয়। না হয় একটা-আধটা ছুটির দিন এখানেই কাটালাম। ছেলেমেয়েগুলোকে তো মানুষ করতে হবে। বহুকাল আগে কলকাতায় নিজেদের জায়গায় গড়ে ওঠে বহুতল বাড়ি। সেখান থেকে নিত্য যাতায়াত করেন প্রশান্ত বাবু। ঘন্টা তিনেকের পথ পাড়ি দিয়ে তার কর্মস্থল। কুসুমকুমারী অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। সরকারি স্কুল। কর্মজীবনের প্রথম দিকে কলকাতার দুটি ফ্ল্যাটের একটি বেচে স্কুলের পাশেই ছোট্ট পুকুরসহ বিঘা দেড়েক একটি জায়গা কিনে রাখেন। সেখানেই ছোট দুটো ঘর আছে। মাঝেমাঝে থেকে যান। স্ত্রীও আসেন। একমাত্র ছেলে প্রবাসী। নিউজার্সিতে কর্মরত। প্রতি সপ্তাহেই ছেলে খবর নেয়। স্কুলের শেষে প্ৰশান্তবাবু ঘন্টাখানেক নিজের ঘরে ডাক্তারি করতেন। কোন কোন দিন রোগীর চাপে রাত গড়াত। থেকে যেতেন। গিন্নি অভিমান করতেন, ঘরে ছেলেটা ছোট। তোমার কি আক্কেল জ্ঞান নেই। প্রশান্ত বাবু রসিকতা করে বলতেন শিশুর তো মা -ই যথেষ্ট। এক আধদিন এরকম হলে না হয় সামলে নিও। রোজ তো হয় না। এক মিশনারী সংস্থার সঙ্গে কিছুদিনের জন্য দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার আইলা বিধ্বস্ত অঞ্চলে ডাক্তারি করতে যান বছর বাষট্টির প্রশান্ত বাবু। ডাক্তারির সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য কাজও করতে হয়। পীড়িত মানুষজনদের খাদ্য তৈরি থেকে বিতরণ পর্যন্ত, প্রায় অনেক রকমই কাজ মাঝে মাঝে করতে হয় তাঁকে। যেদিন ফেরার কথা সেদিন একুশটি বাচ্চাকে উদ্ধার করে আনেন মিশনের স্বেচ্ছাসেবকদল। দুর্গম আইলা বিধ্বস্ত অঞ্চলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা কাজ করে চলেছেন। অসহায় শিশুদের দেখে প্রাথমিক শিক্ষক মায় চিকিৎসক প্রশান্ত বাবুর চোখের কোন চিক চিক করে ওঠে। এদের কি হবে? অস্ফুট স্বর মুখ থেকে বেরিয়ে এল। মিশনের অশীতিপর বৃদ্ধ মহারাজ বললেন, মাস্টারমশাই এদের দেখে মনে হচ্ছে না, কি নিদারুন ! নগ্ন ও অর্ধনগ্ন উসকো-খুসকো চুলে, বাবা-মা-ভাইবোন হারিয়ে শীর্ন অসুস্থ বাচ্চাগুলো আসলে তো আমাদেরই সন্তান। মানব সন্তান। নিষ্পাপ মুখ গুলো কেমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে, তাই না? প্রশান্তবাবু বললেন, মহারাজ যদি অনুমতি দেন, তবে এই বাচ্চাগুলোর দায়িত্ব আমি নিতে পারি। মহারাজ শুনলেন। হাসলেন। বললেন, জানি তুমি পারবে প্রশান্ত। অবনত মস্তকে চরণ স্পর্শ করে উঠে দাঁড়ালেন প্রশান্তবাবু। মহারাজ বললেন, প্রশান্ত মহাসাগরের মত গভীর ও বিস্তারিত হোক তোমার হৃদয়। গড়ে উঠুক দ্বীপমালা । সবুজ হৃদয়ভূমি। নেমে আসুক প্রশান্তির ছায়া। আর সেখানে বসবাস করুক এই হতভাগ্য মানব শিশুর দল। গড়ে তোলো আনন্দ নিকেতন। আইনানুগ কাগজপত্র তৈরি হবার পর একটি বাসে চড়লেন প্রশান্ত বাবু। একুশটি শিশুকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলের পাশে গ্রামের বাড়িতে ফিরলেন। স্ত্রীকে আগের দিন ফোন করে জানিয়ে রেখেছিলেন। বলেছিলেন, একটু না হয় কষ্ট করব। বাকি বিস্তারিত আলোচনা পরে হবে। তুমি ওদের জন্য কিছু জল খাবারের ব্যবস্থা করে রেখো। আমি বেলা দশটার মধ্যেই ফিরব। পরদিন সাড়ে দশটায় যখন ফিরলেন, দেখলেন তার স্ত্রী গ্রামের দু 'জন মহিলার সঙ্গে করে জল খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। শুধু তাই নয়, দুপুরের খাবারের ব্যবস্থারও তোড়জোড় চলছে। স্ত্রী বললেন, এরা থাকবে কোথায় ? খোলা আকাশের নিচে? প্ৰশান্তবাবু প্রথমে চমকে উঠলেন। বললেন,তা কেন? সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি বলে বেরিয়ে পড়লেন। ডেকোরেটার্সের কাছে গিয়ে জানালেন। সে এসে দেখল এবং বলল, দুটো বড় তাঁবু করে দিচ্ছে স্যার। শোয়া-থাকার কাজ আপাতত মিটবে। তারপর আপনি ধীরেসুস্থে ঘর তুলুন। কিছুদিনের মধ্যে ভিত থেকে শুরু করে দেওয়ার উঠল। এসবেস্টসের ছাউনি পড়ল। চার চারটি বড় ঘর তৈরি হতে প্রায় মাস গড়াল। সঙ্গে পায়খানা বাথরুম এবং রান্নাঘরসহ রং হতে আরো দিন সাতেক কাটল। থালা-বাসন চৌকি, বিছানা, মশারি, পোশাক এবং অন্যান্য খরচ করতে গিয়ে প্রশান্ত বাবুকে দুটো এফ ডি ভাঙতে হল। অবশ্য এ ব্যাপারে তিনি চিন্তিত হলেও বাধা দেননি। আনন্দনিকেতনের একুশটি বাচ্চার দায়-দায়িত্ব সামলানো, দাতব্য চিকিৎসালয়ে সময় দান, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো, পঠন-পাঠন করানো, বাজার সরকারের দেখ-ভাল ও নিকেতনের তদারকির পর সময় আর থাকে না বললেই চলে প্রশান্ত বাবুর। স্ত্রী সুমিতাদেবী সারাক্ষন লেগে আছে নানা রকম বিষয় নিয়ে। কাজের লোককে দেখা, রান্নার ঘর সামলানো, খাওয়ার বন্দোবস্ত করা থেকে কলকাতার বাড়িতে যাওয়া ও অন্যান্য কাজে সময় তাকেও বেঁধেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। সুদূর আমেরিকা থেকে ফোন ডেকে ডেকে চলে যায়। ধরার সময় থাকে না বা ধরলেও দ্রুত শেষ করতে হয়। ছেলে রেগে গিয়ে বলে, বাবা না হয় সময় পায় না, তুমি তো সময় দিতে পারো। আর কি যেন বলছিলে, বাবা এফ ডি ভেঙেছে। কেন আমাকে জানাতে অসুবিধা কোথায় ? দূরে থাকি বলে আমি কি তোমাদের কেউ নই ? ডরোথিকে বলেছি। বলেছে তোমার বাবা যখন আর্থিক কষ্টে আছে, তখন কেন সাহায্য করছ না। শোনো মা বাবার দুটো এফ ডি -র টাকা পাঠিয়ে দিলাম। পুজোর ছুটিতে তোমাদের আদরের দাদুভাইকে নিয়ে আমরা তিনজন কলকাতায় যাচ্ছি। মাসখানেক থাকব। আনন্দ নিকেতনের এক কোণে চারটি গরু রাখার ব্যবস্থা করলেন প্রশান্তবাবু। উদ্দেশ্য শিশুদের পুষ্টি জোগানো। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আনন্দের সঙ্গে কাজ করতে থাকে। যদিও দুজন লোককে সারাক্ষণ -এর জন্য বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে। কাঠা ছয়েক জায়গায় নানা রকম মরশুমি সবজির চাষ করার ব্যবস্থা করেছেন। দশ কাঠার ছোট্ট পুকুরটাকে সংস্কার করে মাছ ছেড়েছেন। মাঝে মাঝে যত্ন আত্তি করেন। ঘাট ও পাড় বাঁধিয়ে দু'পাশে গাছ পুঁতেছেন। তাল সুপারি নারিকেল। আম জাম লিচু কলা কাঁঠাল ছাড়াও অন্যান্য ফলের গাছ এবং সঙ্গে সুন্দর ফুলের বাগান তৈরি করেছেন শিশুদেরকে সঙ্গে নিয়ে। অবশ্য এ ব্যাপারে উদ্যান পালন বিদ্যার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও স্পর্শ রয়েছে। ফলে সুন্দর হয়েছে নিকেতন। হয়েছে সাজানো-গোছানো। ছিমছাম। প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ঘন্টাখানেক হেঁটে আসেন প্ৰশান্তবাবু। তারপর চাল ডাল গম ছড়িয়ে দেন নিকেতনের উঠোনময়। উড়ে আসে পায়রা, চড়াই, কাক , শালিক , বুল্বুল ও ঘুঘু থেকে শুরু করে আরো অনেক জানা-অজানা পাখির দল। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা উঠে অবাক হয়ে দেখে কত রকমের পাখি। ওরা ধরতে চায়,পুষতে চায় ।কিন্তু প্রশান্ত বাবু ওদের বলেছেন, পাখিদের বেঁধে রাখতে নেই। ওরা কষ্ট পায়। ছেলেমেয়েরা ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকাজ সেরে হাঁস মুরগির ঘরে গিয়ে খাবার দিয়ে আসে। যদিও গ্রামের কানাইকাকু হাঁস মুরগির দেখাশোনা করেন। এরপর ছেলেমেয়েরা খাওয়ার ঘরে গিয়ে যার যার জলখাবার নিয়ে আসে। খাওয়া শেষ হলে পড়ার ঘরে চলে যায়। সেখানে প্ৰশান্তবাবু ঘন্টাদুয়েক শিক্ষকতা করেন। তারপর ওদের নিয়ে সবজি বাগানে যান। সেখানে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করেন। পরে গোয়ালঘর হয়ে হাঁস-মুরগির ঘরে যায়। রাস্তা ঝাঁট দেন। নোংরা পড়ে থাকলে তা ময়লা ফেলার পাত্রে রেখে আসেন। ছেলেমেয়েরাও হাত লাগায়। পরিষ্কার করে। এরপর স্নান সেরে, খাওয়া সেরে তারা স্কুলে যায় আর প্রশান্ত বাবু তাঁর দাতব্য চিকিৎসালয় সোম থেকে শুক্র বেলা একটা পর্যন্ত রোগী দেখেন। রাতেও প্রতিদিন ন'টা পর্যন্ত। শনি আর রবিবার বেলা দশটায় শহর থেকে চারজন নামকরা চিকিৎসক আসেন। লম্বা কিউ পড়ে যায়। দুপুরে ও রাতে সকলের খাওয়া শেষ হলে নিকেতনের দুই পাহারাদার লালু, ভুলু এবং তাদের সঙ্গী সাথীদের জন্য দুই বালতি খাদ্য প্রতিদিন বিতরিত হয়। ছোট এক বালতি থাকে ষষ্ঠীর বহনের জন্য। প্ৰশান্তবাবু গুটিকয়েক বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে খাবার পরিবেশন করেন। বিকেলে ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে ফিরলে প্ৰশান্তবাবু তার ঘর থেকে ওদের দেখতে থাকেন। ভাবুক হয়ে ওঠেন। মনে পড়ে যায় ছোটবেলার দিনগুলোর কথা। স্কুল ফেরত হৈ হৈ করতে করতে বাড়ী ফিরতেন। মা হালকা কিছু খেতে দিতেন। খাওয়া সেরেই এক ছুট। আমতলা। দিঘীর পাড়। সেই বড় মাঠ। কিন্তু এদের তো কেউ নেই। তাই মাঠে এসে ওদের সঙ্গে খেলতে থাকেন। কখনও হা ডু ডু, কখনও গাদি কিংবা চোর পুলিশ।বেশ মজা পান। সন্ধ্যার আগেই ছেলেমেয়েরা ঘরে ফিরে আসে। টিফিন করে পড়াশুনায় মন দেয়। রাতের খাবার সেরে দশটা সাড়ে দশটায় যে যার বিছানায় শুয়ে পড়ে। আলো নিভে আসে। প্রশান্তবাবুর শুতে রাত হয়। পড়াশোনা করেন। ফাঁকে ফাঁকে ছেলেমেয়েদের ঘরে ঢোকেন, খোঁজ নেন। কোথাও কারও অসুবিধা হচ্ছে কিনা, শরীর খারাপ হলে ওষুধ নিয়ে এসে খাইয়ে দেন। মন খারাপ করলে গায়ে মাথায় হাত বোলান। গল্প করে ঘুম পাড়ান আর স্বজনহারা সন্তানগুলোর উপর যেন এক অদৃশ্য স্নেহের চাদর বিছিয়ে দিয়ে যান।

চন্দন আচার্য

[:]
Dev Sahitya Kutir
Hello, how can we help you?
WhatsApp