তা-ও সাধারণ অবস্থায় নয়। যেন উল্টে ভেসে আছে সাগরের বুকে। ওদের শরীরের দু’পাশে ভেসে থাকার জন্য পাখনার মতো অঙ্গথাকে। সেগুলোও স্পষ্ট। পেট্রের ওপর শোয়ানো। বেশ মজা লাগে দেখতে। এরা এখন বিপন্ন প্রাণীদের দলে। সাধারণভাবে স্তন্যপায়ী সমুদ্র-গরুদের চেহারাও বড়সড় হয়। প্রায় দশ ফুট লম্বা, সাড়ে চারশো কিলোগ্রামের কাছাকাছি ওজন। বেড়ে ওঠা, পরিণত সমুদ্র-গরুদের এ আকারটাই সচরাচর হয়ে থাকে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় প্রচুর পরিমাণে সমুদ্র- গরুদের দেখা যায়। ১৯৮৩ সালে এই বিপন্ন প্রাণীটিকে ঠিকঠাক রাখার জন্য একটি সংস্থাও তৈরি হয়েছে ফ্লোরিডায়। ‘ক্রিস্টাল রিভার রেফিয়ুজ’। মহাকাশবিজ্ঞানীরা ছবিটা পাওয়ার পরে ‘এন. আর. এ. ও’-র বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরকম চেহারার বস্তুকে তাঁরা প্রথমে একটি নাম দেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবিধার জন্য এ কাজটাও জরুরি। সেই নামটা ছিল ‘ডাবলু -৫০’ (W-50)। একে বোঝার জন্য অন্য জরুরি তথ্যও তাঁরা জোগাড় করেছিলেন। শেষমেশ বুঝেছিলেন, এটা আসলে এক মহাজাগতিক বস্তুর ছবি। কোনও জীবজন্তুর নয়। এটুকু বুঝলেই তো হবে না। মহাজাগতিক বস্তুটাকে চেনারও দরকার। শুরু হল ভাবনা-চিন্তা। বোঝা গেল, ওই ছবিটা নানান উপাদানে বড়সড় একটা পিণ্ড মাত্র। এরকম নানান পিণ্ডই মহাকাশে, মহাবিশ্বের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে থাকে। এতদূর থেকে খালিচোখে হয়তো একটা বিন্দুর মতো মনে হয়। তারাই মহাবিশ্বের কত নতুন নতুন খবরাখবর দেয়। এই পিণ্ডটি রয়েছে পৃথিবী থেকে ১৮ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। আলোকবর্ষ তো ভীষণই চেনাজানা এক একক। লক্ষ কোটি কিলোমিটারের হিসেব করার থেকে ছোট করে আলোকবর্ষ বলা অনেক সুবিধে। আলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার বেগে চলে। এক বছরে আলো মহাশূন্যে পেরোতে পারে প্রায় ৯৪ হাজার ৬০০ কোটি কিলোমিটার। এটাই হল এক আলোকবর্ষের মান। এত দূরের জায়গাটা কোথায়, তাও জানা গেছে। ‘আকুইলা’ তারামণ্ডল। বিভিন্ন তারামণ্ডলকে নানান নামে ডাকা হয়। তা না হলে এদের চিনতে ভুল হবে। সংখ্যা তো কম নয়। দ্বিতীয় শতকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমি ৪৮টা তারামণ্ডলের কথা বলেছিলেন। এর পরে আরোও ৪০টি তারামণ্ডলের কথা জানা গেছে। এখনও পর্যন্ত জানা তারামণ্ডলের সংখ্যা হল ৮৮। এদের দলের একটি হল ‘আকুইলা’। নামটি লাতিন ভাষার। একে বাংলায় বলা হয় ‘ঈগল’। তারামণ্ডল হলএকগুচ্ছ তারকা। এদের সকলকে একসঙ্গে দেখলে নানা রকমের জীবজন্তুর চেহারার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। সেজন্যে সেই সব প্রাণীদের নাম অনুযায়ী তারামন্ডলের নাম হয়েছে। বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার শুরুর সময় থেকেই এই চল রয়েছে। ‘আকুইলা’ বা ‘ঈগল’ তারামণ্ডলের নামও পাওয়া গেছে ওভাবেই। বিষুবরেখার মাত্র কয়েক ডিগ্রি উত্তরেই দেখা যায় এই তারামণ্ডল। ওই পিণ্ডটার মধ্যে রয়েছে ধুলো, কয়েক রকমের গ্যাসীয় উপাদান। সব কিছু এক জায়গায় জড়ো হয়ে, মিলেমিশে একটা পিণ্ডের চেহারা নিয়েছে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা আরও অনেক কিছু জেনেছেন। ওই ধুলো, গ্যাসীয় উপাদানগুলো আসলে অবশেষ। প্রায় ২০ হাজার বছর আগে কোনও তারা নিঃশেষ হয়ে গেছে। শুধু পশুপাখি, গাছপালাই নয়, মহাজগতের বস্তুগুলির আয়ুও নির্দিষ্ট। একটি বিশেষ সময় পরে তারাও হারিয়ে যায়। তারাদেরও মৃত্যু হয়। কীভাবে! তারাদের শরীরে অনবরত চলছে পরমাণু বিক্রিয়া। মহাজগতের উপাদানগুলির শরীরে থাকে নানান রাসায়নিক মৌল। এগুলির বিভিন্ন দশায় পরমাণু বিক্রিয়া হয়। তারার শরীরে হাইড্রোজেন পুড়তে থাকে। পরমাণু বিক্রিয়ায় তৈরি হয় ছাই। তাও এক ধরনের মৌল। হিলিয়াম। কত হিলিয়াম তারার শরীরে জমা হবে। তারও একটা মাত্রা আছে। পেরিয়ে গেলেই ঘটে বিস্ফোরণ। সারা শরীর ফেটে পড়ে। তারার বাইরের অংশ আলাদা হয়ে যায় ভেতরের অংশ থেকে। তখনই তৈরি হয় ধুলো, গ্যাসীয় উপাদানের জমাট বাঁধা মহাজাগতিক পিণ্ড। সমুদ্র-গরুর মতো চেহারার পিণ্ডের জন্ম এভাবেই। এরকম পিণ্ডকে মহাকাশবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন নীহারিকা। তারার বাইরের অংশটা নীহারিকার জন্ম দিল। তখন মৃত তারার ভেতরের অংশে কী অবস্থা হয়। তা তৈরি করে কৃষ্ণগহবর বা অন্ধকূপ। সমুদ্র-গরু নীহারিকার পরে পড়ে থাকা অংশটুকুর পরিণতিতে হয়েছিল অন্ধকূপ। এখন ওই মহাজাগতিক বস্তুটির নাম আর ‘ডব্লু-৫০’ নেই, এখন সেটা হল সমুদ্র- গরু নীহারিকা। ফ্লোরিডায় এক উৎসব হয়। ‘সমুদ্র-গরু’ উৎসব। ‘এন আর এ ও’-র বিজ্ঞানী হাজির ছিলেন ওই উৎসবে। বলেছিলেন মহাজাগতিক সমুদ্র- গরুর কাহিনি। সকলেই তাতে রীতিমত বিস্মিত, হতবাক। এরকমও হয়। তাঁরা তো কেউ জ্যোতির্বিজ্ঞানী নন, তাই অবাক হওয়ারই কথা।
- ভবানীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
[:]Copyright © 2024 Dev Sahitya Kutir Pvt. Ltd. All rights Reserved
Design & Developed By SR SOLUTIONS