[:bn]তপন কুমার বৈরাগ্য
একটা প্রাইভেট কার ভদ্রলোককে ধাক্কা মেরে চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল। চারিদিকে ধর-ধর চিৎকার। মাঝবয়সি লোকটা রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে। ফুটপাতের কোনো লোক আহত লোকটাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না। লোকটার মাথা ফেটে রক্ত ভেসে যাচ্ছে। জ্ঞান নেই।
চোখের সামনে এমন একটা দুর্ঘটনা দেখবে নম্রতা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। নম্রতার বাপি গাড়ির স্টার্টটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
নম্রতা অরুনবাবুকে বলল, চলো না বাপি লোকটাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিই। আর দেরি করলে লোকটা বাঁচবে না।
না তা সম্ভব নয়। অরুণবাবু রুক্ষকন্ঠে বললেন।
কেন সম্ভব নয়? মানুষ কি তবে মানুষের জন্য নয়? নম্রতার কন্ঠে মানবিক সুর।
এখন যদি লোকটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই তবে পুলিশ আমাকেই ধরবে। বলবে আমার গাড়িতেই অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটেছে। তখন কি করবি?
তা বলে লোকটাকে এভাবে অসহায়ভাবে ফেলে চলে যাব। ওর মাথা ফেটে কিরকম রক্ত বের হচ্ছে দেখেছ? নম্রতার চোখ দুটো বেদনায় চিকচিক করে উঠল।
অরুণবাবু আবার গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বললেন, আমার হাইকোর্টে দুটো কেসের সওয়াল আছে, তাছাড়া তোমারও স্কুল বসার সময় হয়ে গেছে।
নম্রতা কিছু না বলে হঠাৎ লোকটার দিকে ছুট দিল। অগত্যা অরুণবাবুকেও লোকটার কাছে আসতে হল।
নম্রতা অরুণবাবুকে বলল, তুমি যদি এই জেঠুকে হাসপাতালে না নিয়ে যাও, তবে আমার মরা মুখ দেখবে।
একমাত্র মেয়ে। বড়ই আদরের। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক সময় মেয়ের আবদার মেনে নিতে হয়। এক্ষেত্রেও তাই হল। দু’জনে ধরাধরি করে লোকটাকে গাড়িতে তুলল।
প্রতিদিন হাইকোর্টে যাবার সময় অরুণবাবু নম্রতাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যান। আজও যেতে গিয়ে পথে এই বিপত্তি। মেয়ের ব্যবহার তাঁর কাছে মাঝে মাঝে বড়ই অদ্ভুত লাগে। কোনোদিন যদি ভিখারি এসে সদর দরজায় হাঁক দিয়ে বলে, মাগো, সারাদিন কিছু খাইনি। দুটো খেতে দাও না মা। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করবে। ঘরে তখন আর ভাত নেই। নম্রতার খাবারটা কেবল আছে। নম্রতা নিজের খাবারটা ভিখারিকে দিয়ে দেয়। কখনো কখনো রাস্তায় যেতে যেতে কোনো শীতার্ত অসহায় মানুষকে দেখলে নিজের গায়ের চাদরটা তাকে দান করে দেয়। তার মা,বাবা ভয়ে বকতে পারেন না। মেয়ে তাহলে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেবে। কিছুতেই তাকে শান্ত করা যাবে না। মানুষের জন্য সব সময় তার মন কাঁদে। মানুষের জন্য কিছু করতে পারলেই তার জীবন সার্থক হয়ে ওঠে।
দেখতে দেখতে তারা হাসপাতালে পৌঁছে গেল।
হাসপাতালের কর্মীদের সাহায্যে নম্রতার বাবা ভদ্রলোককে বেডে শুইয়ে দিলেন। ভদ্রলোকের তখনো জ্ঞান নেই। হাসপাতালের ডাক্তারেরা নম্রতার বাপির খুবই পরিচিত। একজন ডাক্তার সত্বর চিকিৎসা শুরু করে দিলেন।
অরুণবাবু নম্রতাকে বললেন, এবার চলো। না হলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে।
ইচ্ছে না থাকলেও নম্রতাকে বাপির সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসতে হল। তাদের কাছে একটা পুলিশের জিপ এসে থামল। একজন ভদ্রমহিলা এবং একজন পুলিশ অফিসার গাড়ি থেকে নেমে অরুণবাবুর কাছে এসে দাঁড়ালেন।
পুলিশ অফিসার বিস্মিত হয়ে জিগ্যেস করলেন, আরে অরুণবাবু আপনি এখানে?
অরুণবাবু সব ঘটনা পুলিশ অফিসারকে খুলে বললেন। ভদ্রমহিলা জিগ্যেস করলেন, উনি এখন কেমন আছেন? ইতিমধ্যে ডাক্তারবাবু বাইরে বেরিয়ে এলেন। ভদ্রমহিলাকে দেখে বললেন, অমলদার জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু এই দুর্ঘটনা ঘটল কি করে?
পুলিশ অফিসার জিগ্যেস করলেন, আপনি এই ভদ্রমহিলাকে চিনলেন কী করে?
ডাক্তারবাবু মৃদু হেসে বললেন, আমি তো ওনাদের বাড়িতেই ভাড়া থাকি।
ভদ্রমহিলা এবার বললেন, আমার শরীর খারাপের জন্য আপনি যে
ওষুধগুলো লিখে দিয়েছিলেন, উনি ওগুলি কিনে আনতে বেরিয়েছিলেন। আর তখনি দুর্ঘটনাটা ঘটে। তবে আমার স্বামী জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
ডাক্তারবাবু প্রতিবাদ করে বললেন, কৃতিত্ব আমার নয, কৃতিত্ব অরুনদা এবং তাঁর মেয়ের। ওনারা যদি ঠিক সময় অমলদাকে হাসপাতালে ভর্তি না করতেন তবে অমলদাকে বাঁচাতে পারতাম না।
ভদ্রমহিলা অরুণবাবুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, আপনারা যা করলেন তার জন্য আমি চিরদিন আপনাদের কাছে ঋণী থাকব।
অরুণ বাবু একটু হেসে বললেন, সব কৃতিত্ব কিন্তু আমার মেয়ের।
ভদ্রমহিলা নম্রতার কাছে দিয়ে নম্রতার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, তোমার মতো মেয়ে যেন বাংলার ঘরে ঘরে জন্মায়। আমি আশীর্বাদ করি তুমি অনেক অনেক বড় হও।
ঠিক সেই মুহূর্তে বাতাসে ভেসে এল ভূপেন হাজারিকার সেই দরদী গান-‘মানুষ মানুষের জন্যে’।[:]