[:bn]আরফান আলি বিশ্বাস
জায়গাটির নাম যদি হয় বি. রা . দী বাগ, তবে কেমন হয়। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় এবং রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় এবং দীনবন্ধু মিত্র স্মরণে জায়গাটির নাম বি. রা. দী বাগ হতেই পারে। কলকাতার বিনয়-বাদল-দীনেশ স্মরণে বি বা দী বাগের মতো।
জায়গাটি অনেকটা ইংরেজি T- এর মতো। তিন রাস্তার সংযোগস্থল। এই তিন রাস্তার সংযোগস্থলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সেই বিখ্যাত জোব্বা পরিহিত মর্মর মূর্তি হয়ে। আর উত্তরদিকে যে রাস্তা গিয়েছে, সেই রাস্তার উত্তরদিকে মুখ করে, ধুতি এবং ফুলহাতা শার্ট পরিহিত, হাতে বই নিয়ে, উত্তরদিকে যেন তাঁর বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছেন মর্মরের বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বামহাতে মহকুমা শাসকের অফিস সহ অন্যান্য অফিস, জেলখানা, বর্তমানে যার নাম সংশোধনাগার। ডানহাতে টাউন হল এবং টাউন লাইব্রেরি, যার পাশ দিয়ে রাস্তা নেমে গিয়েছে দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয়ের দিকে। আর তাঁর পিছনে, দক্ষিণ দিকে যে রাস্তা গিয়েছে তার বামহাতে থানা, ডানহাতে মিউনিসিপ্যালিটি অফিস। দক্ষিন দিকের রাস্তা বরাবর আবক্ষ মূর্তি হয়ে অবস্থান করছেন বিখ্যাত নাটক 'নীলদর্পণ'-এর লেখক দীনবন্ধু মিত্র। আর পূর্বদিকে যে রাস্তা গিয়েছে, তার ডানহাতে থানা, বামহাতে সেই ইংরেজ আমলের মিউজিয়ামে রাখার উপযুক্ত রোডরোলারসহ পি. ডব্লিউ. ডি বাংলো, তার ওপর আবক্ষ মূর্তিতে বিদ্যমান বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম।
বাংলোতে ঢুকে লাউঞ্জ তথা ডাইনিং। সেখানে হাতে আঁকা একটি অসাধারণ ছবি আছে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের। বাংলোর একনম্বর ঘরে ঢুকলে চোখে পড়বে ফ্রেমে বাঁধানো রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়কে। অনেক জায়গায় ছবি বা মর্মরমূর্তি থাকলেও, মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কারক্রতা রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূর্তি অবশ্য এ ত্রিকোণ পার্কে নেই। তাঁকে যদি সেখানে আনা যায়, তবে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় এবং দীনবন্ধু মিত্র স্মরণে ওই জায়গাটির নাম বি রা দি বাগ হতেই পারে। অনেকেই অবশ্য আন্দাজ করে ফেলেছেন যে জায়গাটির নাম বনগাঁ, বনগাঁর 'মনীষাঙ্গন'।
অবশ্য জায়গাটি গাঁ না গাঁও, না গ্রাম, এই নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে। তবে তার আগে বন আছে। গায়ের নাম যদি হয় বন, তবে তার বিস্তৃত বর্ণনার নাই প্রয়োজন।
বনগাঁ শিয়ালদা রেল স্টেশন থেকে ট্রেনেও যাওয়া যেতে পারে বনগাঁ লোকাল ধরে। তবে বাসে বা গাড়িতে রাস্তা ধরে ও যাওয়া যায়। সেই পুরোনো আদি্যকালের ইংরেজদের তৈরি করা রাস্তা। যার বর্তমান নাম যশোর রোড।৩৫ নং জাতীয় সড়ক।
ইছামতীর কোল ঘেঁষে, ইছামতীর ভাটির দিকে অবস্থিত পঞ্চায়েতের অধীন পুরাতন বনগাঁর সঙ্গে কিছুটা মিল থাকতে পারে। কিন্তু ইছামতীর উজানের দিকে পৌরসভা বনগাঁর সঙ্গে অবশ্য মিল খুবই কম। যদিও আগে নাকি কল্লোলিনী ইছামতী জোয়ারের ধাক্কায় উজানের দিকে কিছুটা পিছিয়ে পিছিয়ে আসত, আর ভাটার টানে ভাটির দিকে একটু একটু এগিয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে, নিস্তরঙ্গ স্থবির ইছামতীর দুইপাড়ে বাড়বাড়ন্ত বনগ্রামে,আর বেশিরভাগটাই ভর্তি পানাদামে।
যশোর রোডের উপর অবস্থিত হলেও বনগাঁ এলাকা একসময় নদীয়া জেলার অন্তর্গত ছিল। বনগাঁ সহ নদীয়া জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা একসময় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে নীল বিদ্রোহের দৌলতে। অন্যান্য জেলাতে নীল বিদ্রোহ হলেও নদীয়া জেলা ছিল বেশি উত্তপ্ত। ১৮৫৮ সাল। তার আগে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ এবং ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে ইংরেজ সরকার। সেই সময় ১৮৫৮ সালে শুরু হয় নীল বিদ্রোহ ।
তখন বাংলার ছোটলাট ছিলেন সসিল বীডন। কালবিলম্ব না করে ১৮৬৩ সালে জেলাশাসকের অধীনে বনগাঁ মহকুমা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। মিঃ সি.কুইনি, আই. সি। এস বনগাঙ্গায় প্রথম মহকুমা শাসক হিসাবে নিযুক্ত হন। নদীয়া জেলার একটি মহকুমা হিসাবে বনগাঁ মহকুমার পথ চলা সেই শুরু।১৮৮২ সাল পর্যন্ত বনগাঁ মহকুমা নদীয়া জেলার মধ্যে ছিল। ১৮৮২ সালে জেলাগুলির এলাকা পুনর্বণ্টনের সময় বনগাঁ মহকুমাকে জেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ১৮৮২ সাল থেকে ১৯৪৭ সালের ১৮ আগস্ট পর্যন্ত বনগাঁ মহকুমা যশোর জেলার অংশ ছিল বলে কথিত। মুর্শিদাবাদ, মালদা, নদীয়া জেলার কিছু অংশের মতো বনগাঁ মহকুমা এলাকাও ধন্ধে ছিল ১৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় তার অবস্থান নিয়ে। অবশেষে ১৮ আগস্ট ঐ এলাকাকে চব্বিশ পরগনার সঙ্গে সংযোজিত করা হয়।
যশোর রোড বনগাঁ প্রবেশের মুখে যেখানে ট্রেনলাইনে ধাক্কা খেল, সেটি অবশ্য রানাঘাট-বনগাঁ ট্রেনলাইন। যা অনেক পরে তৈরি হয়েছে। শিয়ালদা-বনগাঁ ট্রেনলাইনের কাজ শুরু হয় ১৮৮২ সাল নাগাদ, কাজ শেষ হয় ১৮৮৪ সালে। ঐ বছরেই ট্রেনলাইন খুলে দেওয়া হয়। বনগাঁ ছুঁয়ে, আঁকা-
বাঁকা লাইন ধরে, ইছামতী এবং কোদালিয়া নদী পেরিয়ে, পেট্রাপোল,বেনাপোল হয়ে ১৯৪৭ পর্যন্ত এই লাইনে চলত বরিশাল এক্সপ্রেস সমেত বহু ট্রেন। এখন অবশ্য বনগাঁ স্টেশনের পরের স্টেশন পেট্রাপোল ভারতের বেনাপোল বাংলাদেশের অন্তর্গত। শিয়ালদা থেকে বনগাঁ বা রানাঘাট থেকে বনগাঁ পর্যন্ত, বনগাঁ স্টেশনে যাত্রা শেষ করে আবার ফিরে আসে। কিছুদিন আগেও কিছু মালগাড়ি পেট্রাপোল পর্যন্ত যেত বলে শোনা গেল।
ফিরে আসার পথেই বামহাতের দিকে দেখা যাবে বিশাল ট্রাক স্ট্যান্ড, ভবঘুরেদের একটি সরকারি আবাস। তার পাশ দিয়ে উঠে একটু উঁচুতে পেট্রাপোল রেলস্টেশন, শ্মশান স্তব্ধতায় নিমজ্জিত। ঐ বামহাতেই পড়বে ছয়ঘরিয়া রাখালদাস হাই স্কুল। স্কুলের সামনে রাখালদাস বন্দোপাধায়ের মমর মূর্তি। স্কুলে ঢোকার আগেই বাম হাতে একটি রাস্তা নেমে গিয়েছে। রাস্তা ধরে অল্প একটু গেলে জোড়ামন্দির দুই দরও য়াজাওয়ালা। বাইরে রাস্তার দিকে একটি দরজা আর প্রাচীরের ওপাশে গৃহমালিকের লোকজনদের জন্য আরো একটি দরজা। গেট পেরিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে পুরোনো সেদিনের স্থাপতে্যর সাদা একটি দোতলা বাড়ি শিবের বাহন নন্দীবাবার মতো শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছে, সম্ভবত তখন থেকেই যখন এই বাড়ির মালিক রাখালদাস মাত্র ৪৫ বছর বয়সে মারা যান। বর্তমানে বাড়িতে রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়ের এক পৌএ এবং তাঁর পরিবার বাস করেন।
ইনিই মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কর্তা রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৫-১৯৩০)। তাঁর জন্ম অবশ্য মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। পিতা মতিলাল, মাতা কালীমতী। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় ১৯০৭ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকেই ইতিহাসে সাম্মানিকে স্নাতক হন এবং ১৯১০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করেন। ঐ বছরেই তিনি কলকাতার ভারতীয় মিউজিয়ামের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া তে অ্যাসিস্ট্যান্ট সহকর্মী হিসাবে এবং ১৯১১ সালে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া তে অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার হিসাবে কাজে যোগ দেন। ১৯১৭ সালে সুপারেন্টেন্ডিং হিসাবে পদোন্নতি হয়। তবে ১৯২৬ সালে স্বেচ্ছাবসর নিতে বাধ্য হন। ১৯২৮ সালে তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী প্রফেসর হিসাবে যোগ দেন। ১৯৩০ সালের ৩০ শে মে অকালমৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই পদে বৃত ছিলেন।
বহু প্রতিভার অধিকারী এই মনীষী বহু প্রবন্ধ, পুস্তক, জার্নাল, ম্যাগাজিন লিখে গিয়েছেন। তাঁর The Origin of the Bengali Script বইটি বাংলা অক্ষরের জন্মআআঁইতিহাস হিসাবে মান্য করা হয়। তাঁর বহু লেখা, বক্তৃতা, Journal of the Asiatic Society, Journal of Bihar and Orissa Research Society, Memoirs of the Archaeological
Survey of India, Annual Reports of Archacological Survey of India প্রভৃতি কাগজে,এমনকি প্রবাসীতেও প্রকাশ পেয়েছিল। শুধু তার জীবনকালেই নয়, বহু লেখা তার মৃত্যুর পরেও প্রকাশিত হয়েছে। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়ের অবদান শুধু বাংলা নয়, ভারত বর্ষ এবং ভারতবর্ষের বাইরে ও সর্বজনস্বীকৃত। বনগাঁ এলাকার এই কৃতি সন্তান মানবসমাজে ততদিন বেঁচে থাকবেন, যতদিন মানবসভ্যতা থাকবে। এটা হয়তো ঘটনা দিয়ে তার প্রাপ্য সম্মান তিনি পাননি, পাওয়া উচিত ছিল।
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় এর সম্পর্কে নতুন কিছু বলার নেই। পথের পাঁচালী সহ তার বেশ কিছু লেখা তাকে অমর করে রেখেছে। বিভূতিভূষণের জন্ম অবশ্য তার মাতুলালয়ে, নদীয়া জেলার কল্যাণীর কাছে ঘোষপাড়া মুরতিপুর গ্রামে। বসতবাড়ি বনগাঁর অদূরে চালকী বারাকপুর গ্রামে। ইছামতীর তীরে প্রাকৃতিক পরিবেশে ভরপুর স্থানে।বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০)- এর পিতা মহানন্দ বন্দোপাধ্যায় একজন সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন। বনগাঁ হাইস্কুলে পড়াশোনা করে কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হন। পড়াশুনা শেষ না করে বাড়ি ফিরে তিনি যে স্কুল থেকে পাশ করেছিলেন, সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে গৌরীদেবীর বিবাহ হয় ১৯২০ সালের প্রথম দিকে। তবে ঐ বছরই গৌরীদেবীর মৃত্যু হয় সন্তান প্রসবের সময়। তাঁর প্রথম ছোটগল্প উপেক্ষিতা প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালে। তবে তাঁর প্রথম উপন্যাস 'পথের পাঁচালী' প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে। আর এই 'পথের পাঁচালী' উপন্যাস তাঁকে খ্যাতির চরমতম জায়গায় নিয়ে যায়। যদিও 'পথের পাঁচালী। ছাড়াও তিনি বহু উপন্যাস রচনা করেছেন।
এই এলাকার ভূমিপুত্র ত্রয়ীর মধ্যে অবশ্যই অন্যতম হচ্ছেন দীনবন্ধু মিত্র (১৮২৯-১৮৭৩), তিনি অবশ্য বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় এবং রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে বয়সে প্রবীণ। দীনবন্ধু মিত্রের পিতার নাম কালাচাঁদ মিত্র। দীনবন্ধু মিত্রের পিতৃদত্ত নাম ছিল গন্ধর্বনারায়ণ মিত্র। কিন্তু তিনি দীনবন্ধু মিত্র নামে পরিচিত ছিলেন।
বনগাঁ-চাকদা রোডের বারাকপুর মোড়ের পরে গোপালনগর। গোপালনগর মোড় থেকে বামহাতে পান্না রোড ধরে বনগাঁ-রানাঘাটের রেললাইন পেরিয়ে নহাটা হয়ে চৌবেড়িয়া খুব বেশি দূর নয়। চৌবেড়িয়া অন্নদাসুন্দরী মিত্র বালিকা বিদ্যালয় ছাড়িয়ে ডানহাতে একটা বাড়ির ভগ্নাবশেষের বাইরেই দীনবন্ধু মিত্রের আবক্ষ মূর্তি। নিচে লেখা দীনবন্ধু মিত্র, জন্ম ১০ এপ্রিল ১৮২৯, মৃত্যু ১লা নভেম্বর ১৮৭৩। বাড়ির বাইরে প্রাচীর কিছুটা এখনো ভগ্ন অবস্থায় বিদ্যমান। পাশে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি। তাঁদের বক্তব্য সরকার থেকে বহুবার দেখে গেছে, কিছু হবে এই আশায় আর সংস্কার হয়নি দীনবন্ধু মিত্রের ভিটে। আরো একটু গেলে অবশ্য বামহাতে চৌবেড়িয়া, ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস। তার ডান হাতে চৌবেড়িয়া দীনবন্ধু বিদ্যালয় ‘নীলদর্পণ’ লেখকের স্মৃতি বহন করে রেখেছে। অবশ্য ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলে বনগাঁতে ইছামতীর কিন্যরে স্থাপিত হয়েছে দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয় বনগাঁয়ের এখনো পর্যন্ত একমাত্র কলেজ।
দীনবন্ধু মিত্রের লেখাপড়া শুরু হয় গ্রামের পাঠশালাতেই। মাত্র এগারো বছর বয়সে স্থানীয় জমিদার কাছারিতে তাঁকে কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ছোট্ট দিনবন্ধু পালিয়ে কলকাতায় চলে যান তাঁর আত্মীয় নীলমণি মিত্রের বাড়িতে। ১৮৪৬ সাল নাগাদ মি. জেমস লঙ -এর ফ্রি স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। খুব মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি বৃত্তীও পান। ১৮৫০ সালে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। আবার বৃত্তি পান। কিন্তু কলেজে শেষ পরীক্ষায় না বসে পোষ্টমাস্টারের চাকরি নিয়ে পাটনায় চলে যান। তারপর পোষ্টাল দপ্তরে নদীয়া, ঢাকা এমনকি ঊড়িষ্যাতেও চাকরি করেন। ১৮৭০ সাল নাগাদ কলকাতাতেও চাকরি করেন পোস্টমাস্টার হিসেবে। তারপর ১৮৭২ সালে তিনি রেল দপ্তরে ইন্সপেক্টর পদে যোগ দেন। ইংরেজ সরকারের লূসাই অভিযানের সময় সহযোগিতা করার জন্য দীনবন্ধু মিত্রকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি দেওয়া হয়।
তবে এসবের জন্য নয়। তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য। কলেজ জীবনেই তাঁর লেখালেখিকে তারিফ করতেন বিখ্যাত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। তাঁর 'সুরধনী' কাব্য প্রকাশিত হয় ১৮৭১ সালে। কিন্তু ইতিমধ্যেই আলোড়ন তুলেছিল তাঁর লেখা 'নীলদর্পণ' নাটক (প্রকাশিত ১৮৬০ সালে)। পোস্টমাস্টারের চাকরি করার সময় তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছিলেন নীলচাষীদের দুঃখ-দুর্দশা আর ইংরেজ নীলকুঠিয়ালদের অত্যাচার-নির্যাতন। ১৮৫৮ সালে নীলবিদ্রোহ তাঁকে আরও ইন্ধন জুগিয়েছিল।
'নীলদর্পণ' নাটক অভিনয় কেমন আলোড়ন তুলেছিল তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণও আছে। একদিন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গিয়েছিলেন ওই নাটকের অভিনয় দেখতে। অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি তখন এ নাটকে নীলকুঠিয়াল মিঃ উড-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। অভিনয় এত জীবন্ত হয়েছিল যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর থাকতে না পেরে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি মিঃ উড-এর দিকে জুতো ছুঁড়ে মারেন। সেই জুতো অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি মাথায় তুলে নেন। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'নীলদর্পণ' নাটককে Uncle Tom's Cabin-এর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
এছাড়াও আরো অনেক নাটক লিখেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র। তার মধ্যে 'বিয়ে পাগলা বুড়ো', 'সধবার একাদশী', 'যমালয়ে জীবন্ত মানুষ' খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।
তাই বনগাঁ শুধু বনের গাঁ বা গাঁয়ের বন নয়, বনগাঁ এলাকায় নক্ষত্রের সমাবেশ। এই তিন কৃতি সন্তান ছাড়াও হয়তো অনেকেই আছেন, যারা এই এলাকার নাম উজ্জ্বল করেছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হয়তো আরও অনেকেই আসবেন। সেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বিগত প্রজন্মের কৃতী সন্তানদের কৃতিত্ব তুলে ধরা বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম দায়িত্ব।
অন্যান্য মনীষীদের সঙ্গে বনগাঁ এলাকার এই তিন কৃতী সন্তানের আরো আরো বেশি করে স্থান হোক বিভিন্ন জনসংযোগ স্থানে, বনগাঁ তথা বনগাঁও তথা বনগ্রামের নাম উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হওয়ার সুবাদে এই আশা করা যেতেই পারে।
[:]