Menu

Min. Order value - INR 300 Delivery Charges Within Kolkata - Free In WB (outside Kol)- INR 75 EZ( Ori, Bih, Jhar) - INR 100 Others In India - INR 150 Outside India - on actuals

[:bn]পৌষে পিঠে-পার্বণ[:]

March 6, 2018
[:bn]শীতকাল মানেই দারুণ ব্যাপার। শীত পরলেই এসে যায় বড়দিন, মেলা, পিকনিক আর পৌষপার্বণ। মানে পিঠে পুলির দিন। দুই তিন দশক আগে ও ছবিটা ছিল অন্যরকম। পুজো, কালীপুজোর রেশ কাটতে না কাটতেই গ্রামাঞ্চলে, মফস্বলের শহরতলীতে শুরু হয়ে যেত রস জ্বাল দেওয়া। শহরে ততটা না হলেও গ্রামের কোনো কোনো বাড়িতে বসত রসের ভিয়েন। সদ্য গাছ কেটে হাঁড়িতে জমানো খেজুরের রস বড় কাঠের উনুনে জ্বাল দেওয়া হতো। গৃহিণীরা স্নান করে শুদ্ধ কাপড়ে রস জ্বাল দিতেন। আস্তে আস্তে তৈরি হতো নলেন গুড়। গন্ধে মাতাল হয়ে যেত পাড়া। তারপর শীত জাঁকিয়ে পড়তেই শুরু হতো পৌষ পার্বণ। অগ্রহায়নের নতুন চাল ঘরে উঠলে তৈরি হতো নানা রকম পিঠে-পুলি আর পায়েস। দুধপুলি, রসপুলি, পাটিসাপটা, চন্দ্রপুলি, পূরণপুলি , গোকুল পিঠে , ক্ষীরসাপটা, রেশমিপিঠে -- কত রকম নাম তাদের। শুধু নামেই নয়, স্বাদে-গন্ধে সবাই আলাদা। সবাই তাদের উপকরণে আর আদর করে ডাকা নামের গরবে গরবিনী। বাংলার একেক জেলায় একেক স্বাদের পিঠে বিখ্যাত। একই পিঠে কোথাও তৈরী হত ক্ষীর দিয়ে, কোথাও তার স্বাদ বাড়ত নারকেলের গুনে। আবার কোথাও মিশিয়ে দেওয়া হত আমসত্ব। গোবিন্দভোগ চাল, বিউলির ডাল বাটা গুলে তাওয়ায় রুটির মতো ভেজে নেওয়া হত 'সরুচাকলি'। পাতলা করে জ্বাল দেওয়া নলেন গুড় দিয়ে খাওয়া হত সরুচাকলি। প্রায় একই রকম পিঠেটি পূর্ববাংলায় পরিচিত 'চিতৈ পিঠে ' নামে। মাটির ছাঁচে চাল বাটা গুলে ভাজা হত গোল গোল চিতৈ পিঠে। গরম গরম সেই পিঠে নারকেল কোরা আর তরল গুড় দিয়ে খাওয়াই ছিল প্রথা। চাঁদের মতো চাঁদপানা মুখ আর চাঁদের আলোর মতো স্নিগ্ধ নরম স্বাদ নিয়ে কোন কোন শীতের বেলায় পাতে এসে পড়ত চন্দ্রপুলি। চন্দ্রপুলি ছিল বাংলায় গৃহিণীদের রান্নাঘর-এর বেস্ট সেলার। তাই প্রণালিটিও ছিল তাঁদের অতি গোপনীয়। কেউ করতেন ছানার,কেউ নারকেলের চন্দ্রপুলি বানাতেন। নারকেল বা ছানা মিহি করে বেটে তাতে খোয়াক্ষীর আর মিছরি মিশিয়ে ক্রমাগত নেরে যেতে হত। তারপর ছাঁচে ফেলে তৈরি হতো অর্ধচন্দ্রাকৃতি চন্দ্রপুলি। কচি নারকেল এবং অত্যন্ত স্নেহ দিয়ে তাকে বাটার ওপর নির্ভর করত চন্দ্রপুলির শ্রেষ্ঠত্ব। পাওয়া যেত নারকেল কুড়ানোর স্পেশালিস্ট। আজকের দিনে চন্দ্রপুলি পেতে হলে হন্যে হয়ে খুঁজতে হবে। চাল, সুজি দিয়ে খোল তৈরি করে তাতে নারকেলের পুর দিয়ে তৈরি হতো গোকুলপিঠে। আবার দুধ-গোকুল তৈরি হতো লুচির ভেতর মুগ ডাল ভাজার পুর দিয়ে। একইভাবে পাউরুটি দিয়েও গোকুল পিঠে তৈরি করতেন অনেকে। বারান্দায় শীতের সোনালী রোদ মেখে জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো, পিসতুতো ভাই-বোনেরা মিলে পিঠে খাবার অনুভূতিই ছিল আলাদা। বেট ফেলা হত কে কটা খেতে পারে পাটিসাপটা বা সেদ্ধপুলি। কাজের শেষে সন্ধ্যায় কর্তারে বাড়ি ফিরলে গৃহিণীরা জল খাবার দিতেন সুগন্ধি চাল আর নলেন গুড়ের পায়েশ দিয়ে। তাতে ভেসে থাকত কাজু-কিশমিশ দেওয়া দুধপুলি। ছড়িয়ে যেত ছোট এলাচের সুবাস। কখনও বানাতেন ক্ষীরের মালপোয়া বা রাঙা আলুর পুলি । সাধারণ মালপোয়া ভেজে তাকে ঘন ক্ষীরের মধ্যে ফেলে দিলেই হয়ে যেত ক্ষীরের মালপোয়া। এমনিভাবে পাটিসাপটাতেও ক্ষীরের প্রলেপ দিতেন কেউ কেউ। এমন মনভোলানো স্বাদ কেমন করে আনতেন তাঁরা পিঠে -পুলিতে? আসলে সেই সময়কার মা-ঠাকুমা-পিসিমাদের আন্তরিকতাই ছিল আসল উপকরণ। যৌথ পরিবারের সকলে মিলে সামলে নিতেন পিঠা তৈরীর ধকল।কেউ দুধ ফোটাচ্ছেন, কেউ নারকেল কুরছেন। মানুষে মানুষে মনের মিলই রান্নায় আলাদা মাত্রা যোগ করত। পিঠে তৈরিতে আঁচের ছিল মস্ত ভূমিকা। তেজ আঁচ, মধ্যম আঁচ, নিভন্ত আঁচ, গুমো আঁচ, মিঠা আঁচ--একেক পিঠের জন্য লাগত একেক আঁচ। সেই সময়কার কাঠকয়লা, ঘুটে বা কাঠের উনুনে কিভাবে আঁচ নিয়ন্ত্রণ করতেন রন্ধন পটীয়সী গৃহিণীরা ভাবলে অবাক হতে হয়। পিঠের গন্ধ আনমনা হয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিলেই দেখা যেত ফুটন্ত দুধের হাঁড়িতে চালবাটা বা রাঙাআলুর পুলি করে তাতে ক্ষীরের পুর দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। জাল দেওয়া মিটসেফের মধ্যে দেখা যাচ্ছে পাটিসাপটা আর ঝাঁঝরিহাতায় করে রস ঝড়ানো হচ্ছে লবঙ্গলতিকার। গুড়, নারকেল, ক্ষীরের পুর দিয়ে ময়দার খোলে পুরে লবঙ্গ দিয়ে আটকে ঘিয়ে ভেজে রসে ফেললেই তৈরি লবঙ্গ লতিকা। শুধু মিষ্টি পিঠে নয় মুখ ফেরাতে প্রচলন ছিল নোনতা পিঠের।শীতকালের সবজি ফল এসবও বাদ যেত না মা-ঠাকুরমার পিঠে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতা থেকে। শীতের রাঙা আলু আর কড়াইশুঁটির মিশ্রণে তৈরি হতো রসনারঞ্জন পিঠে। সিদ্ধ রাঙাআলু আর ময়দা দিয়ে পুলিপিঠের আকারে গড়ে তার মধ্যে কড়াইশুঁটির পুর দেওয়া হত। তারপর একে তেলে ভেজে খাবার অপেক্ষা। আবার দুধের সর, কমলালেবুর রস আর ডিম দিয়ে তৈরি হতো কমলাপিঠে। মহারাষ্ট্রে জন্ম হলেও বাঙ্গালীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল পুরণপুলি। ছোলা, অড়হর ডাল, মুগডাল, কাঁচকলা আর রাঙা আলু দিয়ে তৈরি হয় পুরণপুলি। গ্রেট করা আপেল, দুধ, চিনি দিয়ে ফুটিয়ে ক্ষীরের মতো করে এসেন্স মিশিয়ে তৈরি হতো আপেল-ক্ষীর। অনেকটা এইভাবে গাজর দিয়ে রেশমিপিঠে করতেন অনেকে। বাংলাদেশে তালগাছের প্রাচুর্যের জন্য তালের জাঁক দেওয়া পিঠার স্বাদ ছিল অমৃতসমান। কলা পাতায় মুড়ে যেমন তালের পিঠে হত তেমনি কাঁঠাল পাতায় মুড়ে তৈরি হত কাঁঠালপুলি। নোনতা পিঠার মধ্যে কচি বেগুনের পিঠে ছিল বেশ মুখরোচক। মুগডাল, কড়াইশুঁটির মিশ্রণে তৈরি হতো নোনতা ডালের পিঠে।  এমনই কত নাম না জানা, স্বাদ না জানা পিঠেপুলি উঠে আসত রন্ধনশিল্পের পথ বেয়ে। এখনো শহরে শীত আসে কিন্তু সঙ্গে নিয়ে আসে না পিঠের সেই সুঘ্রাণ। পশ্চিমের অনুকরণে আজকাল জন্মদিনে যেমন পায়েশের বদলে বার্থডে কেক কাটা হয় তেমনই শীতকালেও এখন বাঙালি কেক-পেস্ট্রি খায়। কিন্তু এককালে পিঠে -পায়েশ যে বাঙালির প্রিয় খাবার ছিল তা বোঝা যায় বাংলা সাহিত্য, কবিতার পাতায় চোখ রাখলে। শিশুসাহিত্য থেকে বড়দের প্রবন্ধ সবেতেই পিঠের ছড়াছড়ি।এখন বাঙালির মিষ্টি বলতে বড়জোর ময়রা-মেড রসগোল্লা বা নলেন গুড়ের সন্দেশ। আসলে সময় কোথায় আজকের দশভূজা গৃহিণীদের পিঠে বানাবার। চাকরি, বাচ্চার স্কুল, সংসারের হাজার দায়িত্ব সামলে আবার পিঠেপুলি? অনেক ক্ষেত্রে রান্নাঘরকে বন্দিশালা মনে করে বাঙালি গৃহবধূরা রোজকার রান্নাতেও আউটসোর্সিং করছেন। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার একান্ত আপন পিঠেশিল্প। যে পিঠে বছরের পর বছর বাঙালির রসনাকে তৃপ্ত করেছে, বাংলা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ; এমন কি জাত্যাভিমানে সর্বশ্রেষ্ঠ ইংরেজদেরকেও টলিয়ে  দিয়েছিল যে নলেন গুড় আর পিঠেপুলি,  সেইসব আজ হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের হেঁশেল থেকে। যে ইঁচার মুড়া,গঙ্গাজল, চিরের পিঠে, মুগসামালি, রসবড়া মুহূর্তেই রসনা হয়ে হৃদয়কে  জানান দিত মা দিদিমার হাতের গুন,তারা আজ পিছু হটেছে ক্যালরি, ওবেসিটি, ব্লাডসুগারের চোখ রাঙানিতে|  আজকের ফিগার সচেতন ইয়ং জেনারেশন তো পিঠের নামই জানে না। তাদের কাছে মিষ্টি বলতে পেস্ট্রি নয়তো ডিনারে শেষপাতে সুগার-ফ্রি পুডিং। তার ওপর এখন তো ফাস্টফুডের যুগ । পথ চলতে চলতে চপ -রোল বা কলেজে,ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে চাওমিন, মোগলাই বা পিৎজা দিয়েই তাদের টিফিন সারতে হয়। সেখানে পিঠে পুলির স্থান কোথায়? ফলে বংশপরম্পরায় অজানাই থেকে যাচ্ছে আসকে  পিঠে, ভাজা পিঠের ম ম করা গন্ধ, শীত এলেই পিঠের জন্য মনের আকুলি-বিকুলি। গ্রামের চিত্রটা এখনও  কিছুটা অন্যরকম। এখনও কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা শুরু হলেই পিঠের আয়োজন হতে থাকে। পৌষ-সংক্রান্তিতে নবান্ন উৎসব বাংলাদেশের একেবারে ঘরোয়া উৎসব। চারিদিকে আনন্দের সাড়া পড়ে যায়। মেয়েরা ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনার ব্যস্ত হয়ে পড়ে।সংক্রান্তির দু 'একদিন আগে থেকে শুরু হয় পিঠে খাওয়ার পর্ব। তাতে লাগেনি আধুনিকতার ছোঁয়া। শুরু হয়নি পিঠে প্রণালীতে কাটছাঁট। তাই আজও পুজোর পর থেকে গ্রামের মেয়ে বৌরা পিঠের মহড়া দিতে থাকে। পৌষ পার্বণে, পিঠের মেলায় তাই অন্য আস্বাদ অন্য অনুভূতি। তখন অতিথি থেকে অনাহুত সবাইকে পিঠে দিয়ে আপ্যায়ন। মেলায় পিঠে করা পিঠে খাওয়ার প্রতিযোগিতা সত্যি এই যুগের ব্যস্ত সময়কে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। এইভাবে হারিয়ে যেতে যেতেও গ্রাম বাংলার ঘোমটা টানা আটপৌরে রমণীদের হাতের কারসাজিতে বেঁচে রয়েছে  মিষ্টান্ন শিল্প। সেই কারনেই বোধ হয় পিঠে শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে কলকাতার বেশকিছু মিষ্টান্ন শিল্পী এগিয়ে এসেছেন। নকুড় নন্দী, ভীমনাগ , বলরাম মল্লিক,গাঙ্গুরাম, বান্ছারাম নিজেদের মতো করে বাজারে আনছেন পিঠেপুলি। কেউ চন্দ্রপুলি,পাটিসাপটা, কেউ গুড় পিঠে বা পুরপিঠে পরিবেশন করছেন। বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন বাংলার পুরনো ঐতিহ্যকে। তাই বলি, এই সময়টা রুচি বদলানোর সময়। চলুন যাই পিঠের সাম্রাজ্যে। হলফ করে বলতে পারি, শহরে আধুনিকারাও যদি ঘ্রান নেন এসব পিঠে পুলির--- সাতদিন ঠেলে রাখবেন ফুচকা,ইডলি ,ধোসা ,ফিসরোল ।

দেবযানী বসু

[:]
Dev Sahitya Kutir
Hello, how can we help you?
WhatsApp