[:bn]ভালো কমেডিয়ান আস্তে আস্তে বিরল হয়ে পড়ছে। বাংলা ছায়াছবিতে যে-কজন ভালো কমেডিয়ান এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে দু-চারজনের কথা আমি লেখবার চেষ্টা করেছিলাম। তাঁদের প্রত্যেকেরই যোগ্যতা ছিল, প্রতিভা ছিল। যেমন ধরুন তুলসীবাবু। মানুষটা ভালো নাচতে পারতেন, মুখে মুখে গান বানাতে পারতেন আর অভিনয়ের কথা তো ছেড়েই দিলাম। তুলসীবাবু ভিলেনের পার্ট করেছেন 'মেজদিদি' ছবিতে সেখানেও তিনি সাকসেসফুল। কয়েকদিন আগে টিভিতে ' গল্প হলেও সত্যি' ছবিটা দেখছিলাম। দেখতে যেতে রবি ঘোষের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। রবি ঘোষ ছিলেন আপাদমস্তক মঞ্চের এই অভিনেতা। ওঁর পুরো নাম রবি ঘোষ দস্তিদথিয়ে। পরে দস্তিদার যা উঠিয়ে দেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি দল গড়ে নাটক করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু সেগুলো কোনোভাবেই অর্থাভাবের জন্য মঞ্চস্থ করা সম্ভব হয়নি। তাঁর বাবা ছিলেন এসবের ঘোর বিরোধী। তবু রবিবাবু অভিনয় ছাড়েননি। বরং যত দিন গেছে ততই যেন আরো অনেক নিবিড় ভাবে অভিনয় কে আঁকড়ে ধরেছিলেন।
রবি ঘোষের অভিনয়ের স্ফুরণ ঘটে উৎপল দত্তের সান্নিধ্যে এসেই। তাঁর প্রথম পাবলিক স্টেজে অভিনয় 'সাংবাদিক' নাটকটিতে। এটি পরিচালনা করেছিলেন উৎপল দত্ত। রবি ঘোষ একটা 'কাগজ বিক্রেতা'র রোলে অভিনয় করেছিলেন। চরিত্রটার মধ্যে বিশেষ কিছু করার ছিল না, কেবল প্রবেশ আর প্রস্থান। বিশেষ কোনো সংলাপও ছিল না, তবু ওরই মধ্যে তিনি দর্শকদের মনের মধ্যে একটা ছাপ রেখে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। রবি ঘোষ মূলত উৎপল দত্তের দলেই অভিনয় করে মঞ্চশিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পান। মঞ্চে রবি ঘোষ মূলত সিরিয়াস অভিনেতা হিসেবেই অভিনয় জীবন শুরু করেছিলেন। পরে অবশ্য 'ছায়ানট' নাটকে একজন অজ্ঞ-মূর্খ চিত্র-পরিচালকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেখানে তাঁর অসাধারণ কমেডি সেন্স পাওয়া যায়। 'অঙ্গার' নাটকে রবি ঘোষ শিল্পী হিসেবে নিজস্ব আইডেনটিটি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
'অঙ্গার' নাটকে অভিনয়ের জন্য রবি ঘোষ শ্রেষ্ঠ অভিনেতার উল্টোরথ পুরস্কার পান। তখন পেশাদারি রঙ্গমঞ্চে ছবি বিশ্বাস, নরেশ মিত্র প্রমুখেরা অভিনয় করতেন। তাঁরা সবাই ছিলেন দিকপাল অভিনেতা। আর তখন উল্টোরথ পুরস্কারের খুব নাম ছিল। রবি ঘোষের উল্টোরথ পুরস্কার প্রাপ্তি তাঁর জীবনে একটা বিশেষ ঘটনা। 'অঙ্গারে'র পর রবি ঘোষ বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ডাক পেতে থাকেন। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় 'কিছুক্ষণ' ছবিতে। এরপর মোট দু'শোর বেশি ছবিতে অভিনয় করে গেছেন। রবি ঘোষের অভিনয়-প্রতিভা নিয়ে যদি আলোচনা করি তাহলে প্রথমে এসে পড়ে তাঁর অভিনইয়ের ভার্সেটাইলিটি। মঞ্চে তিনি বেশিরভাগ সময় সিরিয়াস চরিত্রে অভিনয় করে গেছেন। শুধু 'ছায়ানট' নাটকটিতে তিনি আগাগোড়া একটা ভাঁড়ের পার্ট করে গেছেন। কিন্তু 'অঙ্গার' নাটকটিতে কমেডির ব্যাপার-স্যাপার মোটেই ছিল না। তাঁর সংবেদনশীল আবেগময় চরিত্রটি আজও তাঁরা মনে রেখেছেন পুরোনো দিনের যারা তাঁর 'অঙ্গার' নাটক দেখেছেন। তার মানে রবি ঘোষ কি সিরিয়াল কি কমেডি দুটোতেই ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
রবি ঘোষ কে পরবর্তী সময় আমরা দেখে থাকব চলচ্চিত্রে কিংবা মঞ্চে বেশিরভাগটাই কমেডি চরিত্রে অভিনয় করতে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেটা হয়ে উঠেছে অতিরিক্ত পর্যায়ের। সিরিয়াস চরিত্রে রবি ঘোষ অভিনয় করেছেন এমন বিশেষ দেখা যায় না। কেবলমাত্র বিজয় বসু 'বাঘিনী' ছবিটিতে রবি ঘোষকে ভিলেনের পার্ট দিয়েছিলেন এবং রবিবাবু আশাতীতভাবে চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। তাঁর কমেডি চরিত্রে অবতরণ প্রথম-সত্যজিৎ রায়ের 'অভিযান' ছবিতে। সেটাই তার জীবনে ট্রেডমার্ক হয়ে রইলো, সে ট্রেডমার্ক থেকে তিনি বেরুতে পারলেন না। শিল্পী হিসেবে রবিবাবু এই সীমাবদ্ধতা থেকে বেরুতে চেয়েছিলেন কি-না জানিনা তবে চাইলে হয়তো পারতেন। হয়তো এমনও হতে পারে- তিনি 'ঝুঁকি' নিতে চাননি। তিনি যখন পেশাদারি মঞ্চে নাটক করা শুরু করলেন 'সাবাস পেটো পাঁচু' 'কনে বিভ্রাট' 'শ্রীমতি ভয়ঙ্করী' প্রভৃতি তখন আমাদের মনে হয়েছিল তিনি বোধহয় তাঁর কমেডি ইমেজটাকে নিয়েই থাকতে চেয়েছিলেন-কিংবা সান্তনা পাবার চেষ্টা করেছিলেন। অথচ রবি ঘোষ সিরিয়াস চরিত্রে অসাধারণ যে সব কাজ করে গেছেন সেগুলো মঞ্চের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল, চলচ্চিত্রে প্রকাশিত হল না বললেই চলে। রবি ঘোষ শুধু চোখে মুখে নয় সমস্ত দেহ দিয়ে অভিনয় ক্রতেন। আলাদা করে তাঁর ছবিগুলির কথা উল্লেখ করছি না। রবি ঘোষ বাংলা সিনেমার এক অসাধারণ কমেডিয়ান ছিলেন বললে ভুল হবে। তাঁর প্রতিটি অ্যাকশনের মধ্যে থাকত একটা বুদ্ধির ছোঁয়া। যেটা এখন বড় একটা দেখতে পাওয়া যায় না।[:]