[:bn]" পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয়রে ছুটে আয়।" কুয়াশা-মাখা শীতের হওয়ার নাচন লাগা ভোরে গরম চা আর নলেন গুড়ে ডুবিয়ে ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠে--আহা, ভাবতেই মনটা নেচে ওঠে ! কুয়াশার বিস্তার, বেলা না গাড়ালে স্পষ্ট হয় না চারপাশ, গাছের পাতার হলদে গায়ে র, শোনা যায় পাতা ঝরার শব্দ।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় কাঁপন,বাক্স-প্যাঁটরা থেকে বেরিয়ে পড়ে ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখানো লেপ,কম্বল, সোয়েটার, মাফলার। আর আছে মোয়া .... জয়নগরের মোয়া .... আসল জয়নগরের মোয়া--খাঁটি নলেন গুড় আর কনকচূড়া ধানের খই মাখা। পৌষ মানে পাড়াগাঁয়ে খেজুর রসের ম ম করা গন্ধ। পৌষ মানে আস্কে পিঠে , গোকুল পিঠে , পাটিসাপটা, চন্দ্রপুলি, মুগপাকন, গোবিন্দভোগ চালের সঙ্গে পাটালি-- সত্যিই পরমান্ন । পৌষে গেরস্থের ঘর ফসলের পূর্ণ, লক্ষীমাস। শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা। নতুন বিউলির ডাল, টাটকা পালংশাক, সবুজ সিম, নধর লালচে মুলো , মটরশুটি, নতুন আলু, ফুলকপি......। সেই ফুলকপি পুর হয়ে ঢুকে যাবে সিঙ্গারায়। ময়রার দোকানে বোর্ড, ঝোলে -- ফুলকপির সিঙ্গারা ও নলেন গুড়ের সন্দেশ। এবার অবশ্য নলেন গুড়ের সন্দেশের সঙ্গে পাল্লা দেবে নলেন গুড়ের রসগোল্লা। ভোজনপ্রিয়, মিষ্টিপ্রিয়, হুজুগপ্রিয় বাঙালির আহ্লাদের সীমা নেই --রসগোল্লার স্বত্বাধিকার পেল বাংলা। সেদিন আবার বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ছিল, শিশু দিবসও বটে । এন্টি ডায়াবেটিস প্ল্যাকার্ড নিয়ে স্কুলপড়ুয়াদের ওয়াক ছিল চোখে পড়ার মতো,তারই মধ্যে খবর এলো রসগোল্লার স্বত্বাধিকার প্রাপ্তির। কিন্তু এই আমুদে জাতির যে বিরাট অংশে মধুমেহ, অবশ্য রস চিপে দু-একটা আত্মসাতে দোষ কী ? রসনার তৃপ্তি যে পরম প্রাপ্তি, এ থেকে কি নিজেকে বঞ্চিত রাখা যায় ! আর আমাদেরও বাবা বলিহারি ! চল্লিশ পেরোতে না পেরোতেই হাজারটা রোগ শরীরে পুষতে শুরু করি। রোগ নিরাময়ের আগে রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করলেই তো চাপ খানিকটা কমে। প্রিভেনশনই আসল, চিকিৎসা তারপর। সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য সচেতনতা থাকলে, পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা থাকলে, খাদ্যে ভেজাল না থাকলে, পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলে, ঘরে ঘরে ঘরে ঘরে শৌচালয় থাকলে, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখলে ..... বাপরে তালিকা অতি দীর্ঘ ! অবশ্য এসব করতে গেলে মশাদের অবস্থা হবে বড় করুন। যদি জমা জল পরিষ্কার করা হয়, নিকাশি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে থাকে, মশারী টাঙ্গানো হয়, নিয়মিত মশা নিধন করা হয়, তাহলে তো ডেঙ্গুর প্রকোপই থাকবে না, প্রতিরোধের তো প্রশ্নই আসবে না, আর মশারাও খবরের শিরোনামে থাকবে না। সুতরাং এই সব করে কাম নেই, যেমন চলছিল তেমনই চলুক,
গয়ং গচ্ছ ।
ফিরে আসা যাক পৌষের কথায়। পৌষ মানে অজয় নদীর তীরে জয়দেব কেঁদুলির মেলা, শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলা, মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগর মেলা। পৌষ মানে চড়ুইভাতি গিয়ে মাঠে রোদ পোহানো ও দেশি বিদেশি অতিথি পাখিদের কলকাকলি শোনা আর জীবনানন্দ দাশ পড়া।
" শিশির পড়িতেছিল ধীরে ধীরে খসে
নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি
উড়ে গেল কুয়াশায় "
বা
আমরা হেঁটেছি যাঁরা নির্জন খড়ের
মাঠে পৌষ সন্ধ্যায়
দেখেছি নরম নদীর নারী ছড়াতেছে
ফুল কুয়াশায় ".......
জীবনানন্দের কবিতা পরতে পরতে নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতার আভাস মেলে। কল্লোলিনী কলকাতায় থেকেও এই কবি নিজের চারপাশে একটা বলয় নির্মাণ করে স্বেচ্ছানির্বাসন বেছে নিয়েছিলেন নিজেকে অবলোকন করার উদ্দেশ্যে, নিজেকে খুঁজে নেওয়ার বাসনায়। আমাদের জীবনে এই আত্মতর্জমার প্রয়োজন খুব। আত্ম-বিশ্লেষণের মাধ্যমেই আত্মোন্নয়ন সম্ভব, ফেসবুকে অহর্নিশি নিজের ছবি পোস্ট করে 'লাইকের ' সংখ্যা গুনে নয়।
ইংরেজি নববর্ষ অর্থাৎ নিউ ইয়ার দোরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, তাকে স্বাগত জানিয়ে এবং আপনাদের অনেক শুভেচ্ছা জানিয়ে এবারের মত বিদায় নিলাম। খুব ভালো থাকবেন।