[:bn]মেঘমুলুকে এক অজানা বিস্ময় সিলারিগাঁও । উত্তরবঙ্গ-এর উত্তরে ৬০০০ হাজার ফুট উচ্চতায় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সামনে রেখে গুরুং ,তামাং আর থাপাদের মোট তিরিশটি পরিবার নিয়ে একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম সিলারি। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ৯০ কিলোমিটার আর পেডং থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে পাইন ,বার্চ ,ওক গাছের ঠাসবুনোটের মোড়া আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে অল্পচেনা গ্রাম সিলারি। হিমালয়ের টাটকা হিমেল বাতাস, নাম-না-জানা পাহাড়ি পাখির ডাক ,আর সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘার মুগ্ধতায় ভরা এই সিলারি ।
আমরাও প্রকৃতির রূপ-এ মুগ্ধ হতে গত অক্টোবরের শেষে হাজির হয়েছিলাম শিলিগুড়ি ,কালিংপং,পেডং হয়ে সিলারিতে। নিস্তব্ধ সবুজে মোড়া পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে যেন নতুনের ছোঁয়া। সিলারিতে কোনো হোটেল নেই। স্থানীয় পরিবারগুলি তাদের নিজেদের বাড়িতে অতিথিদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন পরমযত্নে। যার পোশাকি নাম 'হোম-স্টে'। আমরা এসে উঠলাম রাজেন থাপার হোম-স্টেতে। কাঠের বারান্দা , কাঠের ঘর-- মনে হয় পাহাড়ের ধাপে যেন বাড়িটাকে গুঁজে দিয়ে গেছে। হাঁটাহাঁটি করলেই ঠকঠক,খটখট আওয়াজ --- দারুন সব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ঘরে এসে বসতেই চলে এল চা। পথের ক্লান্তি হলো উধাও । এরপর পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি মধ্যাহ্নভোজন সেরে বেরিয়ে পড়লাম আশপাশটা একবার ঘুরে দেখবো বলে। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট কাঠের বাড়ি--- একতলা বা দোতলা বাড়িগুলির উঠানে রয়েছে অর্কিড আর রংবেরঙের ফুলের গাছ। ৬হাজার ফুট উঁচুতে এই গাঁ --- দার্জিলিং জেলার মধ্যে হলেও সিকিমের সঙ্গে রয়েছে হাত ধরাধরি করে।
রাজেন থাপা হাত তুলে বাঁদিকে দেখালেন। দামাং ফোর্টের ধ্বংসাবশেষ, আর ডানদিকে পাহাড় বেয়ে পথ চলে গেছে রোমিতেদাঁড়া ভিউ পয়েন্টে। এ দুটোই আমাদের পরদিনের গন্তব্য। একটার পর একটা পাহাড়, তারও পিছনে আরেকটা, শেষ পাহাড়টি যেন মিশে গেছে দূর ধূসর দিগন্তে। ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে মুরগিছানা।ভয় পেলেই দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় খোঁজে মায়ের কোলে । গ্রাম শেষে বিরাট খেলার মাঠ, আর তাকে ঘিরে রয়েছে সারা বাধা ঢ্যাঙা পাইন গাছ। রাতের খাওয়া সারতে সারতে শুনলাম এই গ্রাম গড়ে ওঠার গল্প। শুনলাম সিলারি নামের উৎপত্তি হয়েছে এখানে সিলারি নামে জন্মানো একটি গাছের নাম থেকে । পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ শাসন কাল থেকেই এখানে সিংকোনা গাছের চাষ চলছে । ম্যালেরিয়ার ওষুধ তৈরির কাঁচামাল পাওয়া যেত এখান থেকেই । এখন গ্রামে বিজলিবাতি এসেছে-- তবুও এখানে অনেক সময় এই বিদ্যুৎ থাকে না। তাই আজও ভরসা মোমবাতির আলোযই । গ্রামের পরিবারগুলি তিন-চারটি করে ঘরে করেছে হোম-স্টের ব্যবস্থা--- খুঁজে নিয়েছে বিকল্প রোজগারের পথ। তাই সিলারিতে প্রায় শ'খানেক হোম-স্টে আছে। "পরদিন খুব ভোরে ডেকে দেব। ভোরের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘার দাদাগিরি দেখতে হবে না!"-- বলে গেলেন রাজেনজি। পরদিন ভোরের আলসেমি আর কম্বলের ওম সরিয়ে উঁকি দিই কাচের জানালা দিয়ে। পুব আকাশে রঙ ভরা সবে শুরু হয়েছে। শিশিরভেজা মায়াময় প্রকৃতি জানান দেয় ভোর আসছে পা টিপে টিপে। মাথা-কান শীতপোশাকে বন্দী করে কাঠবারান্দায় এসে দাঁড়াই। উঠে পড়েছেন রাজেনজিও। সামনে চোখ মেলে দেখি দাঁড়িয়ে আছে সপর্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘা। আগুনলাল পাহাড় চূড়া-- এক অদ্ভুত নেশায় বুঁদ হয়ে গেলাম মুহূর্তে।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। যেতে হবে দুই কিলোমিটার ট্রেক করে রোমিতেদাঁড়া ভিউ পয়েন্ট সহ অন্যান্য তুষার শৃঙ্গ গুলিকে আরও কাছ থেকে দেখবো বলে। সঙ্গী হলো রাজেনজির ছোটো ছেলে। আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল সে। একদম ঠাসা জঙ্গল। তার বুক চিরে পাকদন্ডি পথ, চতুর্দিকে নিস্তব্ধ প্রকৃতি-- গাছের পাতা পড়ার আওয়াজও যেন কানে আসছে। গাছের ডালে ডালে পাখি আর প্রজাপতির ভিড়। পায়ের কাছে নেচে বেড়াচ্ছে একজোড়া খঞ্জন দম্পতি। দেখতে দেখতে পৌছে গেলাম পাহাড়ের শেষ কিনারায়। চোখের সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ কাবরু ,পান্তীম,কোকতাং ,নরসিংহ। উপরি পাওনা নিচ থেকে নীলরঙা শাড়ি পড়ে বহমান তিস্তা। এক অপরূপ ল্যান্ডস্কেপ ক্যামেরাবন্দি করে ফিরে এলাম একরাস প্রকৃতির গন্ধে বুক ভরিয়ে। সবুজ কচি শশা, পিয়াজের গোল চাকা , আলু ফুলকপির তরকারি, বাদামি ডিমভাজা,আর সেঁকা পাপড় দিয়ে তাড়াতাড়ি মধ্যাহ্নভোজন সেরে নিলাম। রাজেনজির পরিবারের সদস্যরাই যত্ন করে রান্না করে আমাদের খাওয়ালেন। অতিথিদের যত্নে তারা সবাই সদাই ব্যস্ত।
খাওয়া -দাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়লাম ইতিহাসের সাক্ষী হতে । সিলারিগাঁও থেকে চার কিলোমিটার ট্রেক করে পৌঁছলাম দামসাং ফোর্টের ধ্বংসাবশেষে। স্থানীয় মানুষজন থেকে দামসংগাড়ি -ও বলে থাকেন।
গা ছমছমে দামসাং ফরেস্টের মাথায় এই দুর্গ। শুনলাম ভুটানের তৃতীয় চেলক রাজা এই দুর্গের নির্মাণ করেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দুর্গ প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। রাজার শয়নকক্ষ, ও রাণীর স্নানপাত্র, ঘোড়ার আস্তাবল আজও মনে করিয়ে দেয় দোর্দণ্ড প্রতাপ চেল রাজার স্বর্ণযুগ। ধ্বংসাবশেষ--- তবু যেন মনকে কত দূরে নিয়ে যায় এই দুর্গ। ফিরে এলাম একরাশ স্মৃতি নিয়ে ।
সিলারিগাঁও থেকে ঘুরে নেওয়া যায় রেসিকোলা,রিকিসুম ভিউ পয়েন্ট ,দোরজি গোম্ফা,কোলাঘাম , প্রভৃতি অল্প চেনা নিস্বর্গে । কিন্তু পরদিনই ছিল আমাদের ফেরার পালা। নিউ জলপাইগুড়ি ফেরার পথে রাজেনজি গাড়িতে করে আমাদের দেখালেন সাইলেন্ট ভ্যালি আর সাঙ -চেন -দোরজি মনাস্ট্রি।
সাইলেন্ট ভ্যালি নামকরণ যথার্থই সার্থক । এখানে এসে মনে হলো এত নিস্তব্দ আর নির্জন প্রকৃতি যেন কখনো দেখিনি। পাখিরাও যেন এখানে গান গাইতে ভুলে গেছে।
এরপর গেলাম সাঙ -চেন -দোরজি মনাস্ট্রি। ৩০০ বছর আগে ভুটানি বৌদ্ধরা এই মঠ নির্মাণ করেছিলেন। সবুজের মাঝে এক শান্তির প্রতীক।
গাড়ি এসে পৌছালো নিউ জলপাইগুড়ি রেলস্টেশনে। এবার ফেরার পালা। অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘা,সবুজে মোড়া পাহাড় আর সিলারির মানুষজনের উষ্ণ আতিথেয়তা কে পেছনে ফেলে এবার সত্যিই ফিরে যেতে হবে। মনে পড়ল পাহাড়ের ফাঁকে থেকে দিয়েছিল একটা হিমালিয়ান বুলবুলি । ঝুটি নাচিয়ে বলেছিল, আবার এসো কিন্তু। কথা দিলাম আবার আসবো সুন্দর সিলারিতে ।
যাওয়া : উত্তরবঙ্গগামী যে কোন ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি এসে সেখান থেকে পেডং হয়ে সিলারি। ভাড়া করা গাড়িতে আসা যায় দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার। ভাড়া মোটামুটি।
থাকা : এখানে গ্রামীণ হোম -স্টে ভরসা , নির্মলা হোম -স্টে (৯৬৩৫০০৫৩১৮), সিলারি ভিলেজ হোম -স্টে (৯৯৩২৭৪৪৪৭), হেভেন ভ্যালি (৯৯৩৩৩৯০৯৩৯) ইত্যাদি যে কোনো একটি বেছে নিতে পারেন ।