[:bn]ভুবন দাস একজন পেশাদার খুনি। সুপারি কিলার। অন্তত এক ডজন খুন করেছে এ পর্যন্ত। কাজ তার নিখুঁত। ধরা সে পড়েনি এখনও পর্যন্ত। তার নাম নেই পুলিশের খাতায়। কাজ পাওয়ার ব্যাপারে এটা একটা মস্ত সুবিধা। কাজের সঙ্গী বলতে একজন-- রাজু সেখ। গায়ে তার অসম্ভব শক্তি। কিন্তু বুদ্ধির ঘাটতি আছে। ভুবন বলে-- তোর মাথায় গোবর পোরা, বুঝলি রাজু ? খ্যা খ্যা করে হাসে রাজু, শিয়ালের মত। বলে--কর্তা , ওই জন্যই তো তোমার কাছে এইসে জুটেছি। বুদ্ধি তোমার, শরীলের জোর আমার।
রাজুর কথায় একটু বাঙাল টান আছে। বোধহয় বাংলাদেশ থেকে আমদানি। ভুবন জিজ্ঞেস করেনি কোনওদিন। ব্যক্তিগত কথা জানার আগ্রহ তার কম। রাজুর কথা শুনে ভুবন হাসে। বলে, বোকা হলেও মাঝে মাঝে তুই বেশ চালাক চালাক কথা বলিস রাজু । লোকে ভুল করে ভাবতে পারে যে তোর খুব বুদ্ধি। কিন্তু আমি জানি তোর বুদ্ধির বহর।
তা ঠিক। কর্তা , তুমি আছো বইলেই দু'পয়সা আয় করতেছি আমি। নইলে কুথায় ভেইসে যেতাম। দাঁত বার করে হাসে রাজু। বেশ ঝকঝকে দাঁত তার। ভুবনের হিংসে হয়। তার নিজের দাঁত ক্ষয়ে যাওয়া। মাঝে মাঝে হলদেটে ছোপ ছোপ।
ভুবনের অস্ত্র ছুরি। শরীরের মোক্ষম জায়গায় আঘাত হানতে সে ওস্তাদ। দুবার চালাতে হয় না। প্রাপ্তবয়স্ক কোনো ভিকটিম যদি জোর করে বাধা দেয়, এগিয়ে আসে রাজু। চেপে ধরে ভিকটিমকে। ভুবন নির্বিঘ্নে ছুরি চালিয়ে দেয়। অন্যত্র তুলে এনে খুন করতে গেলেও প্রথম কাজটা করতে হয় রাজুকে। তারপর ভুবন নামে আসরে।
তাদের কাজের ক্ষেত্র শহরে। কিন্তু তারা থাকে দূর শহরতলীতে। ট্রেনে আসে,ট্রেনে করে ফিরে যায়। শহরের বুকে রেখে যায় এক প্রাণহীন দেহ। যার রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে।
পুরো অপারেশনে এক তৃতীয় ব্যক্তি আছে-- রেজ্জাক মিঞা। তার মাধ্যমেই এ সমস্ত ডিল । ভুবনের মোবাইল ফোন আছে। রেজ্জাকের কাছ থেকে খবর আসে কোডে। ভুবন চলে যায় রাজুকে নিয়ে। রেজ্জাকের সামনেই ডিল ফাইনাল হয় পার্টির সঙ্গে। পঞ্চাশ ভাগ অগ্রিম। বাকি পঞ্চাশ ভাগ অপারেশন শেষ হবার ১৫ দিন বাদে। যখন ঘটনাটা থিতিয়ে আসে অনেকটাই। এ ব্যবসায় কথার খেলাপ না। তাছাড়া রেজ্জাক মিঞা আছে। খুব হুঁশিয়ার লোক ।
তাকে কমিশন দিতে হয় পনেরো ভাগ। ভিকটিমকে সরিয়ে এনে অন্যত্র খুন করতে গেলে গাড়ির প্রয়োজন। সে ব্যবস্থাও তার। এজন্য অতিরিক্ত কমিশন ৫ শতাংশ। সমস্ত কাজটা হয় ভীষণ গোপনীয়তা রক্ষা করে। সুপারি নেবার পর ভুবন স্পটের আশপাশটা ঘুরে দেখে নেয়। ভিকটিমকে চিনে নেয়। জেনে নেয় পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি। ঘুরাঘুরির সময় ছদ্মবেশ নেয়, যাতে সে সন্দেহের কোনো কারণ না ঘটে। এই পর্বে সে রাজুকে সঙ্গে রাখে না।
অপারেশনের সময়ও ছদ্মবেশ থাকে। হাতে পড়ে গ্লাভস । পায়ের জুতোয় যে সোল্ ব্যবহার করে তার ছাপ পড়ে না চট করে। রাজুকেও সে ভাবেই তৈরী করে নেয় ভুবন।
কথায় কথায় একদিন রাজু বলল, একখান কথা কই কর্তা। শাদি করন তো চাই। কিন্তুক তোমার রেট বড় কম। পরতা পোষায় কই। এই টাকায় শাদি করন যায় না। কিছু বাড়াও ,কর্তা।
ভুবন চিন্তা করে বলল, ঠিকই বলেছিস। এবার থেকে কিছু বাড়াতে হবে।
অল্প বাড়ায়ে কি হবে? রেজ্জাক মিঞাই তো একটা বড় হিস্যা লেয় ।
দ্যাখ রাজু, কাজ তো দেখ রাজু কাজ তো রেজ্জাকই দেয়। অনেক হেল্পও করে। রেজ্জাক না দিলে শহরে কাজ পেতাম কি করে? আমার বা তোর তো তেমন জানাশোনা নেই।
তা ঠিকই কইছ কর্তা ।
কিন্তু রেজ্জাক কি রাজি হবে রেট বাড়াবার ব্যাপারে? রাজি কেন হবে না ? হ্যারও তো তাইতে লাভ। ঠিক আছে, দেখি।
দেখি -টেখি না, কর্তা। এখন না কইরলে আর কবে শাদি করুম। ত্রিশের ওপর বয়স হইল দুইজনারই । বড় দুখ লাগে,কর্তা । তুমি শাদি কর নাই। আর আমার বিবিটা তো ভেগেই গেল । হেই হালাকে যদি একবার হাতের কাছে পাইতাম।
ছাড়ান দে পুরানো কথা। এখন ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে।
তাই তো কই, কর্তা , আমাগো দুইজনারই জলদি শাদি করতে লাইগব। তার জন্যি আরও টাকা জমাতি হবে।
ভুল কিছু বলিসনি তু্ই,রাজু । রেট বাড়াতেই হবে।
শাদির কতার জবাব তো কিছু দিলে না,কর্তা ।
ভাবব রে ভাবব। দু 'তিনটে অপারেশন আরও করি। ব্যাংক ব্যালেন্সটা আরেকটু বাড়িয়ে নি। টাকা না থাকলে বউও ভেগে যাবে, বুঝলি রাজু। ঠিকই কইছ, কর্তা। টাকা না থাকলি নিজের বিবিও মানতি চায় না।
রাজু জানে না ভুবনের জীবনের সব কথা। বলেওনি সে। কলঙ্ক আর অপমানের কথা বলা যায় না। বরাবর সে পেশাদার খুনি ছিল না। রাজমিস্ত্রির কাজ শিখেছিল সে,এই ঘৃণ্য কাজে নামার আগে। বছর খানেক ছিল এক দক্ষ মিস্ত্রীর জোগানদার। সোনাই মিস্ত্রীর সঙ্গে লেগে থাকলে তিন -চার মাসের মধ্যেই কাজ শিখে যেত। কিন্তু ভবিতব্য তা নয় ।
এক বাড়িতে জোগানদারের কাজ করতে গিয়ে পাশের বাড়ির মেয়ে বিউটির সঙ্গে ভাব হল তার। বাবা-মা কেউ নেই। দূর সম্পর্কের এক কাকার বাড়িতে গতর খাটিয়ে, কাকা-কাকিমার মুখ ঝামটা আর মার খেয়ে দু'বেলা অন্ন জুটত তার। বয়স সতের -আঠারো। সহানুভূতি স্বরে ভুবন একদিন তাকে বললো, তুই আমার সঙ্গে যাবি, বিউটি?
কেন যাব না বসে বসে কাকা -কাকির মার খাব নাকি? রোগা রোগা চেহারা। পান্ডুর মুখে রক্তাল্পতার ছাপ। তবু , ভুবন প্রেমে পড়েছিল। কাজ শেষ করে যাবার সময় বিউটিকে নিয়ে পালালো। মা কালীর মন্দিরে মালাবদল করে বিয়ে করে, ঘরে তুলল তাকে। কৃতজ্ঞ বিউটি বলল, তুমি আমার কাছে ভগবান। ভগবান হতে চাই না। তুই আমার ঘর করবি, আমাকে ভালবাসবি, তাহলেই আমি খুশি। বিউটির চিবুকটা নেড়ে দিল ভুবন।
কয়েক মাসের মধ্যেই শরীর-স্বাস্থ্য ফিরল বিউটির। গায়ের রং ফর্সাই ছিল। ফর্সা গালে একটা রক্তআভা দেখা দিল। ভুবন যখন ভাবছে ভুল সে করেনি, বিউটি বেশ কিছু টাকাপয়সা,গয়নাগাটি, শাড়ি -টারি নিয়ে পালালো একদিন। বিয়ের এক বছরও তখন পুরো হয়নি। দুঃখ থেকে রাগ হল বেশি। কৃতজ্ঞতার বহর দেখে রাগ। প্রতিজ্ঞা করল ভুবন--শোধ সে নেবে। নাগরটিকে সে চিহ্নিত করতে পারেনি। কাজকর্ম মাথায় উঠল। সে উঠে পড়ে লাগলো দু জনের সন্ধানে। অবশেষে মিলল সন্ধান। দু 'স্টেশন পরে একটা ছোট টাউনশিপে উঠেছে বিউটি আর তার নতুন নাগর। লোকটার মুখ চেনে ভুবন। ছুতোর মিস্ত্রির কাজ করে।
এবার শুরু হলো নজরদারির কাজ। টাউনশিপের প্রান্তে বস্তিমত এক জায়গায় ব্যারাক বাড়ির একটা ঘরে সংসার পেতেছে বিউটি তার নাগরকে নিয়ে । বাড়িটা দোতলা হলেও বিউটিদের ঘরটি এক তলাতে। গরমের দিন, জানলা খোলা রেখেই ঘুমায়। ঘরের একটাই দরজা। সেটা বন্ধ করে দিলে ভিতরের লোক বেরোতে পারবে না।
দিন সাতেকের দেখা শোনার পর একদিন রাত এগারোটা নাগাদ এল ভুবন। পিঠের ঝোলানো ব্যাগে বেশ কিছু সরঞ্জাম। বিউটিদের ঘরের কাছে গিয়ে ব্যাগ খুলে একটা ছোট ,সরু বাঁশের লাঠি বার করল। লাঠির ডগায় ভালো করে জড়াল পাট আর ন্যাকড়া ।একটা ছোট টিন থেকে কেরোসিন ঢালল পাট আর ন্যাকড়া জায়গাটায় । তারপর ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে পকেট থেকে দেশলাই বার করে আগুন জ্বেলে ধরিয়ে দিল লাঠির ডগায় । জ্বলে উঠতেই লাঠিটাকে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে দিল ঘরের মধ্যে বিছানায় টাঙানো মশারি লক্ষ্য করে। শিকল তুলে দিয়েছিল আগেই। ঘরের ভিতর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠতেই, দ্রুত স্থান ত্যাগ করল ভুবন। মিলিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে।
পরে সে খবর নিয়েছিল ৯৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়াদেহ দেহ দুটি হাসপাতালে যাবার পথেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। মৃত্যুকালীন কোনও জবানবন্দি তারা দিয়ে যেতে পারেনি। ব্যারাক বাড়ির লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোন ক্ল খুঁজে পেলোনা লোকাল থানার পুলিশ। কেসটা বাতিলের পর্যায়ে চলে গেল শেষ পর্যন্ত। নিশ্চিন্ত হল ভুবন। একটা উপলব্ধিও হল তার। মানুষের প্রাণ নেওয়া তাহলে খুব কঠিন ব্যাপার নয়।
অনেক ভাবল সে। রাজমিস্ত্রির জোগানদারের কাজ করে কত মজুরি সে পায়? রাজমিস্ত্রি হলেই বা কত পাবে? অথচ প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলা মানুষগুলোর প্রয়োজন মেটাতে পারলে মিলবে অনেক টাকা। রোজ কাজে যাবার হ্যাপাও নেই। এক একটা কাজের পর বেশ কিছুদিনের বিশ্রাম। জগত এখন পাল্টে গেছে। বাঁচতে গেলে টাকা চাই। অনেক টাকা। টাকা না থাকলে ছুঁচোও লাথি মারে। বউ পালাবে সে আর বেশি কি। নিজের সিদ্ধান্তে অনড় রইল ভুবন। পেশাদার খুনীই সে হবে। মানুষের জানের কী দাম ! কত লোক তো রাস্তায় মরে পড়ে থাকে।
সঙ্গীও একজন পেয়ে গেল সে-- রাজু শেখ । রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল রাজু হন হন করে। কোনও দিকে হুঁশ নেই যেন। পেছন দিক থেকে একটা ট্রাক প্রায় ধাক্কা মারছিল তাকে। ভুবন ছিল কাজেই। ঠেলে সরিয়ে বাঁচায় রাজুকে। বেঁচে গিয়েও তড়পানি-- কেন আমাকে বাঁচালে,কর্তা ? তোমারি চিনি না, জানি না। তোমার কি দায় ছেল আমারে বাঁচাতি ?
তুই মরতে যাচ্ছিলি কেন?
ভাবিজানের কথায় ভাইজান আমারে ঘর থেইকে তাড়ায়ে দিল। বইলল,বইসে বইসে আর কত খাবি তুই? বাড়ি থেইকে বারায়ে যা। নিজে কইরে খা।
তোর গায়ে তো তাকাত আছে। তুই কিছু করতে পারলি না?
কী কইরব ? ভাইজানরে মাইরব ?
দরকার হলে তাই করবি । ছেড়ে দে ওসব কথা। তুই আমার সঙ্গে কাজ করবি ?
কী কাম ,কর্তা ?
মানুষ মারার কাজ।
চমকে উঠলো রাজু, কি বইলছ গো ,কর্তা ?
ঠিকই বলছি ।
এটাও একটা কাজ । যারা নিজেরা পারেনা, তারা টাকা দিয়ে নিজের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা শত্রূকে মারে লোক লাগিয়ে। এসব লোককে বলে সুপারি কিলার। আমি এই কাজই করব। এতে অনেক টাকা । তুই আসবি আমার সঙ্গে?
রাজুর কি হল। হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বুক চিতিয়ে বলল হ আসুম ।
এই ভাবেই জুটি বাধলো দুজনে। রেজ্জাকের সন্থান রাজুই দিয়েছিল। দূরসম্পর্কের আত্মীয়তা আছে দুজনের। রেজ্জাক যে মস্তান ধরণের লোক এবং তার বেআইনি কাজ-কারবার আছে, তা জানত রাজু। রেজ্জকের মাধ্যমে সুপারি পেয়ে গোটা বারো খুন ভুবনরা সেরে ফেলেছে, বছর তিনেকের মধ্যে। সুচারুভাবে শেষ করেছে কাজ। ফলে চাহিদা বেড়েছে ভুবনের।
রাজু যে শাদির কথা তুলেছিলে একদিন, মনে ধরেছে ভুবনের। নারীশূন্য জীবন কত দিন কাটাবে। একটু আদর, একটু যত্ন, একটু উষ্ণ স্পর্শ না হলে বেঁচে থাকার অর্থ কী। টাকার অভাব কিছুটা হলেও মিটেছে। ব্যাংক একাউন্ট খুলেছে দুজনেই। টাকাও জমেছে মন্দ নয়। তবে অনিশ্চিত পেশা। আরো গোটা দুয়েক অপারেশন চালিয়ে ব্যাংক বালান্সটা বাড়িয়ে নেওয়া দরকার। তারপর ভাবা যাবে সংসার ধর্মের কথা।
শিগগিরই এল রেজ্জাকের কোডেড মেসেজ। তার মানে আরেকটা কাজের ডাক। পার্টির সঙ্গে সোজা কথা বলিয়ে দিল রেজ্জাক। বাবাকে পৃথিবী থেকে সরাতে চায় ছেলে। একমাত্র সন্তান। মা নেই। আশি বছরের বাবা প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকার সম্পত্তির মালিক।বুড়ো মতো এক কাজের লোককে নিয়ে নিজের বাড়িতে থাকে। ছেলে তাকে অন্যত্র। সামান্য চাকরি অথচ বড় সংসার। মাইনের টাকায় চলে না। ছেলের আর্থিক কষ্ট দেখেও বাবা হাত উপুর করে না। কোন টানই নেই ছেলের প্রতি । বয়স আশি হলেও বুড়োর শরীর মজবুত, খুব সহজে মরবে না । ছেলে আর অপেক্ষা করতে পারছে না, ওই সম্পত্তি তার এখনিই চাই। বাবাকে সরাতে হবে। খুনটা এমনভাবে করতে হবে যেন ডাকাতির উদ্দেশ্যেই তা করা হয়েছে। কাজের লোকটাকেও বাঁচিয়ে রাখা যাবে না । ছেলে বলল, তোমরা ধরা পড়লে পুলিশ আমাকেও ছাড়বে না। সে ক্ষেত্রে সব প্লানই হবে ব্যর্থ। য্ককে মেরে লাভ হবেনা। সম্পত্তি আমারও ভোগ হবেনা। ভুবন বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আপনি যা বলছেন সেভাবেই কাজ হবে। তবে দশ হাজার বেশি চাই।
দশ হাজার ? কি বলছ? এমনিতেই রেট তুমি বাড়িয়ে বলেছ। কী রেজ্জাক ভাই ,আপনি কিছু বলুন।
রেজ্জাক হাসল, টাকার ব্যাপার আপনাদের। আমি না কুছু বলব না।
ভুবন বলল দু-দুটো খুন কি সোজা ব্যাপার ভাবছেন আপনি। মানুষের প্রাণের দাম নেই।
শেষ পর্যন্ত বাড়তি টাকাটা রফা হলো আট হাজারে। আর একটা শর্ত হল, ডাকাতির মাল রাখা হবে রেজ্জাকের কাছে, ঝামেলা মিটলে ছেলে নিয়ে যাবে।
কাজটা সহজেই হল। দুই বুড়ো কত বাধা দেবে? রাজুর গায়ের জোরের সঙ্গে তারা পারবে কেন। সেলোটেপ মুখে চেপে দিয়ে, দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো দুজনকে দু'ঘরে। আলমারি খুলে গয়নাগাটি, টাকা-পয়সা বার করে ব্যাগে ঢোকালো রাজু। ভুবনের পরামর্শে দামী কয়েকটা শাড়িও ব্যাগে স্থান পেল। এগুলো নিজেদের জন্য। বিয়ে করলে বউকে যৌতুক দেওয়া যাবে। শাড়ির কথা শর্তে ছিল না ।
এবার আসল কাজ সেরে চম্পট দিতে হবে। আশি বছরের বৃদ্ধের মুখ বাঁধা। কিছু বলার চেষ্টা করছে, কোন আওয়াজ বেরোচ্ছে না। দু'চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। প্রাণভিক্ষা চাইতে বোধহয়। নিজের বাবার মুখটা মনে পড়লো ভুবনের। তবে মুহূর্তের জন্য। সেন্টিমেন্টের স্থান নেই এই পেশায়। কোমরে গোঁজা ছুরিটা বার করে মোক্ষম জায়গায় বসিয়ে দিল সে। রক্তের ধারার মাঝে চোখ দুটো উল্টে গিয়ে স্থির হয়ে গেল বৃদ্ধের দেহটা। বাইরের ঘরে কাজের লোকটারও একই পরিণতি করে দুই দুষ্কৃতী যখন বেরোল, মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে চন্দ্রিমা। গাঢ় হয়েছে অন্ধকার, রাস্তার আলো থাকা সত্বেও।
আরেকটা অপারেশন শেষ করতে পারলে বেশ কিছুদিন বিশ্রাম নেবে তারা। রেজ্জাক জানিয়েছে শিগগিরই একটা কাজ আসবে।ভালো সুপারি মিলবে। এই কাজটার পর গা ঢাকা দিতে হবে বেশ কয়েক মাসের জন্য । বিয়েটা সেরে ফেলতে হবে তার মধ্যেই। রাজুকে বলতে সেও খুশি। নাজমা নামে একটা মেয়ের সঙ্গে ইতিমধ্যে তার আলাপ হয়েছে অল্প সল্প। গরিব ঘরের মেয়ে। অভাবের তাড়না থেকে মুক্তি পাবে জানলে শাদিতে রাজি হবে নিশ্চয়ই। নিজের সংসার সব মেয়েই চায়। অভাব-অনটন নয় চায় সংসারে সুখ-স্বাচ্ছন্দ।
মাস দুয়েক পরেই এল রেজ্জাকের বার্তা। ভুবন গেল ডাক পেয়ে। চাকরির কারনে স্বামীকে মাঝেমধ্যেই বাইরে যেতে হয়। স্বামীর অনুপস্থিতিতে বউ প্রেম করে বেড়ায় পরপুরুষের সঙ্গে। হাতে-নাতে প্রমাণ মিলেছে। তাই বৌকে সরাতে হবে পৃথিবী থেকে। খুনটা বাড়িতে করা যাবে না। অন্যত্র তুলে নিয়ে গিয়ে করতে হবে। যাতে মনে হয় প্রেমিকের হাতে খুন হয়েছে। স্বামী সেসময় অফিস ট্যুরে বাইরে থাকবে। সেটাই হবে তার আলিবাই।
ভুবন রেট কিছুটা বাড়িয়ে বলল। পার্টি তাতেই রাজি। বলল টাকা আমি দেবো, কিন্তু কাজ করতে হবে নিখুঁতভাবে নইলে সব টাকা ফেরত দিতে হবে। রেজ্জাক ভাই, এটা পরিষ্কার করে বলো তোমার লোককে।
রেজ্জাক বলল ,ভুবন ভাইয়া ,তোমকো মাননা পরতা ,বাত সহি হ্যায় ।
জরুর, জরুর। কাম তো ঠিক সে হোনাই চাহিয়ে । উত্তর দিল ভুবন। নিজের ওপর অগাধ আস্থা তার।
অগ্রিম টাকা পকেটে পুরে সে জিজ্ঞেস করল, সময় কত দেবেন। কাজ হাসিলের জন্য সময় তো কিছু চাই।
ঠিক একমাস। তার বেশি নয় ।
শুরু হলো নজরদারির কাজ। দেখেশুনে ভালো করে বুঝে নেবার পালা। রেজ্জাক খুঁতখুঁতে লোক, এদিক-ওদিক হলেই কাজ দেওয়া বন্ধ করবে। ভুবনও তাই সতর্ক।
সময়সীমা পেরোতে দু ' দিন বাকি। ইশারা এসে গেল পার্টির কাছ থেকে। ট্যুরের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। দু'তিন দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে।
কৃষ্ণা চতুর্দশী মাঝ রাতে যাত্রা শুরু একটা টাটা সুমো গাড়ির। ড্রাইভার ইসমাইল ছাড়া দুজন যাত্রী। দুই পেশাদার খুনি-- ভুবন এবং রাজু। লক্ষ্য উত্তর কলকাতার গলির এক দোতলা বাড়ি। মেন্ রোড থেকে হাঁটা পথে সামান্যই দূরে। গলির মুখে গাড়িটা এসে দাঁড়ালো যমদূতের মত। ইসমাইল গাড়িতেই রইল। দুই সুপারি কিলার এগিয়ে গেল,বাড়িটার দিকে। বাড়ির গ্রিল ভাঙা এদের কাছে রবার পাইপ বাঁকানোর মত সহজ। গ্রিল ভেঙে বারান্দার দরজায় অটো-লক অতি সহজেই খুলে দু'তলার শোয়ার ঘরে ঢুকে গেল দুই দুষ্কৃতী।
মৃদু নীলাভ আলোতে মায়াবী হয়ে আছে ঘরটা। জুঁই ফুলের সৌরভ ঘরের বাতাসে। খাটের সুন্দর শয্যায় শুয়ে এক অপরূপ নারী। পরনে হালকা গোলাপি রঙের নাইটি। কিছুক্ষণের জন্য বাক্যহারা হল নিষ্ঠুর দুই মানব। তাদের মনে হল স্বর্গের পরী যেন নেমে এসেছে।
অবচেতন মনেও যেন টের পেয়েছে নারী বিভীষণদের আগমন। ঘুমটা ভেঙে গেলো তাই। সামনেই দুই দুষ্কৃতীকে দেখে প্রচণ্ড আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল সে--- কে --কে তোমরা? কি চাই?
ভুবনের হুঁশ ফিরল প্রথম। তাড়াতাড়ি মুখ চেপে ধরল মহিলার। রাজুও জ্ঞানে ফিরেছে । সেলোটেপ বার করে মুখে সেঁটে দিল। তারপর দড়ি দিয়ে হাত পা বেধে ফেলল। বৃথা গেল একক প্রতিরোধ। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সামনে জমাট অন্ধকার।
ভুবন তাড়া লাগাল--রাজু বডিটা তুলে নে । দেরি হয়ে যাচ্ছে।
তুলে আমি নিচ্ছি কর্তা । তবে এরে মারতি আমি দেবনা।
মানে ? কি বলছিস তুই ? পার্টির থেকে টাকা নিয়েছে আমরা। কাজ তো করতেই হবে। খতম করতে হবে মেয়েটাকে।
টাকার কথা ছড়ান দাও,কর্তা । টাকা আমি ফিররে দেব। বেহস্তের হুরিকে নে গে আমি নিকে করব।
ভুবনের খারাপ লাগছিল পরির মত সুন্দরী এক মহিলাকে একেবারেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে। রাজুর কথা শুনে মনে একটা ভাবনা খেলে গেলো তার মাথায়। একে খতম না করে সে যদি বিয়ে করে নেয়, তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। পার্টিরও কাজ হাসিল হয়,তার নিজের ইচ্ছাও পূর্ণ হয়।
সে বলল দেখ রাজু ,এ হিন্দুর মেয়ে, বিয়ে করতে হয় আমি করব। ধম্ম দেখায় না কর্তা । আর একডা কথা বলি, আমার জেনানার উপর তুমি নজর দেবা না। তাইলে তোমারে আমি নিকেশ কইরে দেব।
কী , এত বড় আস্পর্ধা তোর? আমাকে নিকেশ করবি ? মোহময়ী নারীর মোহে আচ্ছন্ন ভুবন। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।কোমরের গোঁজা ছুরিটা বার করে আমূল বসিয়ে দিল রাজুর বুকে। এত দ্রুত ঘটনাটা ঘটে গেল যে রাজু বাধা দেবার এক মুহূর্ত সময় পেল না। তার দেহটা একটুক্ষণ স্থির থেকে ধপ করে পড়ে গেল মেঝেতে। মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর এক আর্তনাতের সঙ্গে যোগ হলো এক নীরব আর্তনাদ। হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেও কাঁপছে মহিলার দেহ। সে কাঁপন আসছে শরীরের ভেতর থেকে।
ছুরিটা রাজুর বুক থেকে এক টানে বের করে সেটা রক্তাক্ত অবস্খাতেই কোমরে গুজে ভুবন ঘাটের দিকে এগিয়ে গেল। তুলে নিল মহিলার দেহ। এগোতে লাগলো দরজার দিকে। হঠাৎ মৃত শরীরে যেন প্রাণ ফিরে এলো। উঠে দাঁড়ালো রাজু। অতি দ্রুত ভুবনের কাছে গিয়ে তার কোমর থেকে খুলে নিল ছুরিটা । অপটু হাতে ঢুকিয়ে দিল সেটা ভুবনের পেটে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে রাঙিয়ে দিল ঘরের দেওয়াল। মেঝেও রক্তে থিকথিকে। শক্তি শেষ। রাজুর বিশাল শরীরটা ধপ করে পড়ে গেল মেঝেতে। ভুবন মহিলাকে কাঁধে নিয়েই চেষ্টা চালালো এগিয়ে যাবার।পারল না। তার দেহটা পরল রাজুর ওপর। মহিলার মাথা ঠুকে গেল রক্ত ভেজা মেঝেতে।
ইসমাইল অপেক্ষা করছিল গাড়িতে । মিনিট পনেরোর মধ্যে অপারেশন শেষ করে মহিলাকে নিয়ে চলে আসার কথা দুজনের। আধ ঘণ্টা হতে চলল অথচ দেখা নেই লোকগুলোর। রেজ্জাক ভাইয়ের নির্দেশ আছে কোন পরিস্থিতিতে কী করবে। নেমে এলো সে গাড়ি থেকে। গাড়ি লক করে গলিপথ ধরে এগিয়ে গেল নির্দিষ্ট বাড়িটার দিকে। রেজ্জাক ভাইয়ের পরিকল্পনায় ত্রূটি থাকে না। একাধিক গেম প্ল্যান করা থাকে তার। বাড়িটা ইসমাইলেরও চেনা। ভীষণই চেনা। দোতলার ঘরটায় ঢোকার মুখে কোমরে গোঁজা পিস্তলটা একবার হাত বুলিয়ে নিল সে।
এরপর রাতের নীরবতাকে ভেঙে একটা গুলির শব্দ। পড়ে রইল তিনটি প্রাণহীন দেহ। টাটা সুমো গাড়িটা মূহুর্তের মধ্যে স্পিড তুলে বেরিয়ে গেল গলির মুখ থেকে।