[:bn]সুমথবাবু ভেবেছিলেন কোনো সাহিত্য- সভায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে এসেছে ছেলেটি। অথবা কোনো পত্রিকায় নিজের কোনো লেখা প্রকাশের সুপারিশ চাইতে এসেছে তাঁর কাছে। যেমন আসে অনেকেই। কিন্তু এ যে একেবারে দূর মফস্বলের অখ্যাত, অজ্ঞাত , সদা আবির্ভূত, একটি ছোট্ট কিশোর পত্রিকার জন্য তাঁর লেখা চাইতে এসে উপস্থিত।
বিরক্ত গলায় ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন সুমথবাবু, ‘তোমাকে লেখা দিয়ে আমার লাভ?’
‘আপনাকে অবশ্যই সম্মান- দক্ষিণা দেব পত্রিকার পক্ষ থেকে।’ছেলেটির বিনয়ী উক্তি। ‘হয়তো যথোপযুক্ত হবে না, তবুও দেব সাধ্যমত।’
সুমথবাবু থমকালেন। বুঝতে পারলেন- ছেলেটি সাহসী, স্পষ্ট- ভাষী।
‘তা না হয় হল। কিন্তু আমার একটা লেখা তোমাদের ওই পত্রিকায় দিয়ে নষ্ট করব কেন? ক’টা লোক পড়বে? এটা নিশ্চয় মানবে যে প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার সম্পাদকেরা আমার লেখা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন?’
‘আপনার মতো প্রখ্যাত সাহিত্যিকের লেখা পেলে একদিন হয়তো আমাদের পত্রিকাও প্রতিষ্ঠা পাবে।’
‘তাই।’সুমথবাবুর স্তম্ভিত হওয়ার পালা। ‘এত নিশ্চিত?’
কোনো উত্তর না দিয়ে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা থেকে কতগুলো পত্রিকা বের করে ছেলেটি –‘একটু সময় করে দেখবেন স্যার। গত বৈশাখ থেকে মোট সাতটি সংখ্যা বের হয়েছে। পত্রিকাটি মাসিক। নতুন বলে প্রথমবার পূজা সংখ্যা স্পেশাল কিছু করা যায়নি। গতানুগতিক ধারা থেকে আমরা একটু অন্যরকম কিছু করার চেষ্টা করছি।’
হাতে নিয়ে পত্রিকাটি নাম দেখলেন সুমথবাবু- গজমতি। মনে পড়ল, ওয়াকিবহাল মহলের রীতিমতো আলোচিত হচ্ছে গজমতি। তাঁর দু-চারজন লেখক- বন্ধুর মুখেও শুনেছেন পত্রিকাটির কথা। কৌতুহলী হলেও উদাসীন ভাব দেখালেন তিনি। এসব কথা প্রকাশ করলে খ্যাতনামা সাহিত্যিকের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়ে পড়ল।
সামান্য নাড়াচাড়া করে দু- একটা পাতা উলটে সম্পাদকের নাম পড়ে প্রশ্ন করলেন সুমথবাবু, ‘মনসিজ চক্রবর্তী। ইনি কে?’
‘আজ্ঞে এই অধম।’
আবার ভ্রু কোঁচকালেন সুমথবাবু – ‘কী করো তুমি?’
‘একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লাইব্রেরিয়ান। আর তার সঙ্গে বর্তমানে এই পত্রিকাটির সম্পাদনা।’
‘নিজে লেখালিখি করো নিশ্চয়?’
‘ না, এক্কেবারে না। ওই সম্পাদকীয়টুকু- ই। তবে পড়ি। খুব পড়তে ভালোবাসি।
‘সাহিত্যের ছাত্র?’
‘আমার ডিগ্রিটা সায়েন্সের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি. এস. সি। কিন্তু স্যার, আমি সাহিত্যপাঠক।’
সুমথবাবু কথা দিলেন,‘বেশ, আমি লিখব। ছোট গল্প।’
‘অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার।’ছেলেটি হাতজোর করল। তারপর ঝুলি থেকে একটা সাদা খাম বের করে সুমথবাবুর হাতে দিল।
সুমথবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা?’
‘আপনার সম্মান- দক্ষিণা। যৎসামান্য-ই। মাত্র দু’শো টাকা। স্যার, আপনার ভাবনার বা শৈলীর মূল্য দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। তবুও, মনে করুন কাগজ ও কালির খরচ বাবদ।’
সুমথবাবু খুশি হলেন। হেসে বললেন, ‘বেশ। ঠিক দিন সাতেক পর এসে লেখাটা নিয়ে যেও।’
দিন সাতেক পরে সুমথবাবুর কাছে এসে উপস্থিত এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক। এসে জানালেন, তাঁকে মনসিজ পাঠিয়েছেন। সঙ্গে একটি হাত- চিঠি।
চিঠিটা পড়ে তাঁর মাধ্যমে লেখাটি পাঠিয়ে দিলেন সুমথবাবু।
এর ঠিক দিন পাঁচেক পর কুরিয়ারের মাধ্যমে একটা খাম পেলেন সুমথবাবু। খুলে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন- তাঁর প্রেরিত গল্পটি ফেরত পাঠিয়েছে মনসিজ। সঙ্গে একটি চিঠিঃ-
মান্যবরেষু,
আপনার লেখাটি আমাদের চাহিদা পূরণ করতে না পারার জন্য ফেরত পাঠালাম। আশা করি, ভুল বুঝবেন না। ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন।
বিনীত
প্রীতিভাজন
মনসিজ চক্রবর্তী
চিঠিটা পড়ে প্রচন্ড অপমানিত বোধ করলেন সুমথবাবু। রেগে গেলেন খুব। তাঁর পঞ্চাশ বছরেরও অধিক লেখক জীবনে শেষ করে লেখা অমনোনীত হয়ে ফেরত এসেছে তা মনে করতে পারলেন না। সন্তান- তুল্য এক ছোকরার এত স্পর্ধা।
চিঠির কোনায় একটা ফোন নাম্বার দেখে সেই মুহূর্তে নিজের মোবাইল থেকে সেই নম্বরে ডায়াল করলেন সুমথবাবু। অপর প্রান্তে মনসিজেরই কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন, ‘হ্যালো। কে বলছেন?’
‘সুমথনাথ বন্দোপাধ্যায়।’
‘ও, স্যার। নমস্কার, নমস্কার স্যার।’
‘কী ব্যাপার।’ সুমথবাবু ক্ষিপ্ত, ধৈর্যহীন।
‘মানে-লেখাটা ফেরত পেয়ে ফোন করছেন নিশ্চয়?’
‘অবশ্যই! কী মনে করো তুমি নিজেকে? এত স্পর্ধা কী করে হয় তোমার?’
‘স্যার খুব রাগ করেছেন মনে হচ্ছে।’ ও প্রান্তের কণ্ঠস্বর নম্র, বিনয়ী। ‘আমি নিজেই আপনার কাছে যেতাম স্যার। গিয়ে বুঝিয়ে বলতাম। কিন্তু উপায় নেই। হঠাৎ পা ভেঙে বসে আছি। মাসখানেকের ধাক্কা তো বটেই।’
‘আমার গল্পটা কোথায় আটকেছে জানতে পারি?’
‘স্যার, ওই গল্পটি আমার ছোট কাগজে বেরোলে পাঠকেরা বলতো ওটির লেখক অন্য কোন সুমথনাথ বন্দোপাধ্যায়। অথবা বলতো আমার লেখা আপনার নাম করে চালিয়ে দিয়েছি।’
অত রাগের মধ্যেও মনে মনে ছেলেটির কথা বলার মুনশিয়ানার তারিফ করলেন সুমথবাবু। কত কঠিন কথা, কত সহজে বলে দিল ছেলেটি।
কঠিন কণ্ঠে শুধোলেন তিনি,’যাক, এবার বলো, তোমার দু’শো টাকাটা আমি ফেরত পাঠাব কী ভাবে?’
‘ওই টাকাটা আমি ফেরত চাই না স্যার।’
‘মানে!’আরও রেগে গেলেন সুমথতবাবু।
‘ আমি লেখা চাই। আপনি লিখুন।’
‘ আমার লেখা তোমার পছন্দ হবে না।’
‘হবে। যদি না-ই হবে- আপনার কাছে আমি গেলাম কেন?’
সুমথবাবু চুপ করে থাকেন। কয়েক সেকেন্ড পর প্রশ্ন করেন, ‘কী ধরনের লেখা চাই তোমার?’
‘ ধরনের নয় স্যার, চাই মানের। সে সব মানের লেখা একসময় আপনি লিখেছেন ও প্রচুর।’
‘যেমন?’
‘ যেমন পদ্মনাভের ছেলে, চম্বলের ডাকু, চক্ষুদান, ভবিষ্যদ্বাণী ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক।’
সুমথবাবু হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন অতীতে। অনেক অনেক বছর আগের দিনগুলিতে। প্রায় পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেকার জীবনে। তখন প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই। তিনি প্রচুর লিখেছেন, সর্বত্র। আশ্চর্য। ওই ছোকরার জন্মের ও আগের কথা এসব। এসব গল্পও ও পড়েছে। সংগ্রহ করে নিশ্চয়।
সুমথবাবু কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে দিলেন।
সেদিন সারাক্ষণ ছটফট করলেন সুমথবাবু। লেখায় একেবারেই মন বসাতে পারলেন না। একটা অস্বস্তি তাঁকে পীড়া দিতে লাগল।
সন্ধ্যের দিকে চা পান করার পর তিনি আলমারি ঘেঁটে বের করলেন পুরনো দিনের বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা। খুঁজে বের করলেন ছেলেটির
উচ্চারিত শিরোনামের সেই সব গল্পগুলো । আচিরেই মগ্ন হয়ে গেলেন গল্পগুলোতে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পড়তে লাগলেন সেগুলো । পাঠক হয়ে, ঠান্ডা মাথায়। অন্য আবেশে।
অনেকগুলো ফরমায়েশি লেখা ছিল। কিন্তু দু’দিন কোনো লেখাতেই হাত দিলেন না সুমথবাবু। ছেলেটি তাঁর আত্মসম্মানে বড় ধাক্কা দিয়েছে। ছুড়ে দিয়েছে এক মস্ত চ্যালেঞ্জ। একটা ভালো লেখা তাঁকে যে লিখতেই হবে।
গল্পগুলো করা শেষ করে এবার ছেলেটির দেওয়া পত্রিকার সংখ্যাগুলি নিয়ে বসলেন তিনি। একেবারেই দেখার সময় হয়নি। ভুলেও গিয়েছিলেন লেখার চাপে। হয়তো দেখতেনই না, যদি না ধাক্কা থাকেন এভাবে ।
পত্রিকাটির গুন-মান বোঝার জন্য সেগুলো দেখা অবশ্যই জরুরি।
দিন সাতেক পর নিজের সারাক্ষণের কাজের লোক মিন্টু প্রসাদের হাত দিয়ে মনসিজের ঠিকানায় অন্য একটি গল্প লিখে পাঠালেন সুমথবাবু।
মনসিজের ফোন এল সন্ধ্যের একটু পর। ‘আপনার অসীম দয়া স্যার।’
অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে মোবাইল কানে চেপে রাখলেন সুমথবাবু। কী বলতে চায় ছোকরা আগে বোঝা দরকার।
‘ আপনার গল্প পেয়ে আমরা সম্মানিত স্যার । এই গল্প আমাদের পত্রিকার মানকে অনেক ওপরে পৌঁছে দেবে স্যার।’
‘তোমার কেমন লেগেছে?’
‘ দারুন! দারুন, অনবদ্য স্যার!’ আবেগতারিত কণ্ঠস্বর। ‘বলেছিলাম না, আপনি পারেন, অবশ্যই পারেন স্যার।’
প্রত্যুত্তরে কথা ফোটে না সুমথবাবুর। ঠিক বুঝতে পারেন না- আনন্দে কি দু’টি চোখের কোণ ভিজে এল তাঁর?
এই মুহূর্তে সুমথবাবু অনুভব করলেন, একটি সুন্দর নিপুণ রচনার জন্য যেমন লেখকের একাগ্রতা প্রয়োজন, তেমন একজন সম্পাদকের ভুমিকাও কম নয়।
প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর তাঁর নামটি নিয়ে অনেকেই শুধু বাণিজ্য করে গেছেন। বিচ্যুতির কথাটি কেউ ধরিয়ে দেননি তাঁকে।