[:bn]দোকানের নাম ‘কিউরিও শপ্।’ বাইরে থেকে বোঝা যায় না কিছুই, কিন্তু দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সাদা আর রঙিন আলোর বন্যায় থৈ থৈ করছে সমস্ত ঘরটি।
শো-কেসগুলিতে থরে থরে সাজানো অদ্ভুত সব জিনিস। থালা,বাসন,খেলনা ,পুতুল ,ফুলদানি ,বাতিদান,ঝাড়লণ্ঠন আর জন্তু-জানোয়ারের যেন নিঃশব্দ হট্টগোল।
ঘরের মাথায় রঙিন কাগজের শিকল ঝুলছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত অবধি। তার ফাঁকে ফাঁকে রূপোলী জরির ফিতে ঝুলছে লম্বা হয়ে।
সব মিলিয়ে সুন্দর সাজানো দোকান।
দোকানটি মিস্ উইলটনের। বয়স অল্প হলেও বেশ চটপটে। সারাদিন কলেজে পড়াশোনা করে আর বিকেলে দোকান খুলে বসে। একাই বিক্রি করে আর দাম নেয়।
দোকানের একটু দূরেই গলির মধ্যে পিটার উডের বাড়ি। তিনি আদালতে ওকালতি করেন। কিন্তু এখনো পেশায় ঠিকমত জমিয়ে বসতে পারেননি। তবে আশা আছে একদিন বড় হবেনই।
সেদিন সন্ধ্যায় তিনি ফিরছিলেন এই দোকানের পাশ দিয়ে। হঠাৎ মনে হল পরশু তাঁর এক বন্ধুর বিয়ে এবং একটা কিছু উপহার দেওয়া দরকার।
কথাটা মনে হতেই দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেন দোকানের মধ্যে।
সত্যি মুগ্ধ হবার মত। শুধু দোকানের চেহারা নয়, মালিকের চেহারাও।
‘আসুন আসুন’- স্বাগত জানালেন উইলটন।
হাসিমুখে কাছে এসে পিটার উড তাঁর আগমনের উদ্দেশ্যটা জানালেন।
উইলটন একটা শো-কেস থেকে একটা ফুলদানি নিয়ে এসে বললেন, ‘এটা দিলে কেমন হয়? ভারতবর্ষের জয়পুরের জিনিস। কী সুন্দর সূক্ষ্ম কাজ দেখেছেন?’
হাতে নিয়ে দেখলেন পিটার উড।
‘বাঃ, ভারি সুন্দর। এইটাই দিন।’
দোকানে ভিড় ছিল না। তাই আলাপও জমে উঠল। জিনিসটা কাগজের মুড়ে প্যাক করতে করতে উইলটন বললেন, ‘আপনি কাছেই থাকেন অথচ একদিনও এখানে পদার্পণ করেননি। জানেন, আমার বাবা এই দোকানটি করেন। প্রথমে তেমন চলত না। তারপর একটা দুষ্প্রাপ্য জিনিস ভারতবর্ষের এক রাজাকে বিক্রি করে প্রচুর লাভ করেন। আর সেই থেকে আমাদের ভাগ্য খুলে যায়। হাজার হাজার বছরের পুরানো ভাস্কর্য শিল্প বিক্রি করা বাবার এক অদ্ভুত নেশা ছিল।’
‘আমার অবশ্য ওসবে কোন নেশা নেই।’ বললেন পিটার উড। ‘তবে আলাপ যখন হল তখন মাঝে মাঝে আসব নিশ্চয়ই।’
ফুলদানিটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন পিটার উড।
প্রায় এক সপ্তাহ পরে একদিন সন্ধ্যায় লন্ডন শহরে হঠাৎ শুরু হল তুষারপাত। আর সেই সঙ্গে প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া আর জোলো ঠাণ্ডা। বাইরে বেরোনো তো দূরের কথা, ঘরের মানুষদের হাড়কাঁপুনি লেগে যাবার যোগাড়।
আদালত থেকে ফেরার পথে ভারী মুশকিলে পড়লেন পিটার উড।
হাওয়ায় এক পা এগোয় কার সাধ্য, আর তুষারের গুঁড়োগুলো কাঁটার মতো বিঁধছে চোখে-মুখে। পরনের প্যান্ট-কোট ভিজে সপসপে হয়ে যাচ্ছে।
এভাবে বাড়ি অবধি পৌঁছনো যাবে না কিছুতেই।
পাশেই সেই কিউরিও শপ। অতএব...
কিন্তু ঢুকতে গিয়ে থেমে গেলেন পিটার উড।
‘দোকান বন্ধ’নোটিশ ঝুলছে দরজার হাতলে। আর হাতল থেকে হাতটা সরিয়ে নেবার আগেই একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল।
হাতলটা ঘুরছে আস্তে আস্তে। বোধহয় আপনা থেকেই অথবা ভিতর থেকে কেউ ঘোরাচ্ছে।
ক্লীক্? এবার দরজাটা খুলছে। একটু একটু করে সবটা খুলে গেল।
ঘরের মধ্যে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
ব্যাপার কী?
না, এই অন্ধকারের মধ্যে তিনি ঢুকবেন না। কিছুতেই ঢুকবেন না। চলে যাবেন। কিন্তু আশ্চর্য, তিনি একটুও নড়তে পারলেন না। তাঁর মনে হল ভিতরের অন্ধকার তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে- এসো, এসো, এসো।
এদিকে বাইরে ঝড়- জলে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। অবশেষে পিটার ঢুকে পড়লেন সেই দোকানের কালো জমাট অন্ধকারের মধ্যে। আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে হল, বাইরের অপেক্ষা ঘরের মধ্যে যেন আরো বেশী ঠান্ডা।
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসবার জন্য ঘাড় ফেরাতেই দেখলেন খোলা দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ক্লীক্। শব্দ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।
পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে রক্তের একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল পিটারের। অজানা আতঙ্কে বুকটা একটু থরথরিয়ে উঠলো যেন।
তাঁর মনে হল ভেতরে আসা ঠিক হয়নি।
বেশ তো, দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলেই তো হয়। কে আটকে রেখেছে তাঁকে?
ইচ্ছা হচ্ছে খুবই। কিন্তু পারছেন কই? পা দুটো কে যেন মাটির সঙ্গে গেঁথে দিয়েছে।
‘মিস উইলটন, আপনি কোথায়? আমি পিটার উড।’
এই কি পিটার উডের গলা?
আদালতে সওয়াল করার সময় যে গলায় বাজ ডাকত সে গলায় এখন বিড়াল ডাকছে।
কোন সাড়া নেই। প্রতিধ্বনি ফিরে এল পিটারের নিজের কাছেই।
আর ঠিক সেই সময় তাঁর কানের পাশে কে যেন বলে উঠল, ‘একটু অপেক্ষা করুন আমি এখনি আসছি।’
না, এ কণ্ঠস্বর উইলটনের ত নয়ই, কোন মানুষেরই নয়। নিশ্চয়ই কোন অশরীরীর।
পিটার ভেবে পাচ্ছেন না, তিনি কী করবেন। আর করবার কীই বা আছে। কোন এক প্রচন্ড শক্তির আকর্ষণে তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
বাদুড়ের মত কালো কালো কুৎসিত অন্ধকার ঝুলছে ঘরের মধ্যে। দরজার কাঁচের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরেও সেই নীরন্ধ্র অন্ধকার। ঝড়-জলে সমস্ত লন্ডন শহরটাই বোধ হয় নিষ্প্রদীপ হয়ে গেছে।
এবার ক্ষীণ একটা আলোর রেখা দেখা গেল।
বাতি জ্বালিয়ে কে যেন আসছে কাউন্টারের ভিতর থেকে। আর সেই ক্ষীণ আলোয় দোকানটা আরো রহস্যময় হয়ে উঠল।
আলো হাতে লোকটা সামনে এসে দাঁড়াতে রীতিমত চমকে উঠলেন পিটার।
মুখে স্পষ্ট বলিরেখা। সর্বাঙ্গে লোলচর্ম। বার্ধক্যে কুজ তার পিঠ। রাতের প্রদীপের আলোর মত চোখ দুটি স্তিমিত। মড়ার মত । যেমন রুগ্ন তেমনি ক্লান্ত।
‘কী নেবেন?’মাকড়সার জালের মত সূক্ষ্ম কণ্ঠস্বর।
‘এসেছি যখন তখন কিছু একটা নিতেই হয়’- কোনরকমে বলতে পারলেন পিটার, ‘দিন যা হয়।’
বাতিটা শো-কেসের ওপর তুলে ধরে লোকটি বললে, ‘এইটে নিন।’
‘কী ওটা?’
‘চুনা পাথরের তৈরি একটা ব্যাঙ।’
‘ব্যাঙ?’ পিটারের মনে হল তার মুখটাও যে ঐ ব্যাঙের মত হয়ে গেল।
‘হ্যাঁ,এটা নিয়ে যান।’
‘কত দাম?’
‘আট পেনি।’
‘কি বললেন,’ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না পিটার।
লোকটি এবার হাসল। না, হাসি ঠিক বলা যায় না। ঠোঁটটা ফাঁক করল একটু।
ভয়ে রক্ত জল হয়ে গেল পিটারের। এমন বিশ্রী হাসি তিনি জীবনে কারোর দেখেননি। অন্ততঃ কোন জীবিত মানুষ এমনভাবে হাসতে পারে বলে মনে হয় না।
‘আট পেনি।’ লোকটি আরো স্পষ্ট করে বলল।
পকেট থেকে পয়সা বার করে তিনি লোকটির হাতে দিলেন। হাত তো নয় যেন বরফের কাঠি।
জিনিসটা পকেটে নিয়ে পিটার দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন।
বাইরে এখনো সমানে ঝড় আর তুষারপাত হচ্ছে। আর তেমনি হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। তবু রক্ষে, ঐ ভয়াবহ লোকটার সঙ্গ ত্যাগ করা গেছে।
না, যায়নি।
পিটারের মনে হল লোকটার দৃষ্টি এখনো তাঁকে অনুসরণ করছে। কথাটা মনে হতেই তিনি ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন, দরজার কাঁচের ওপর দুটো মরা চোখ রেখে লোকটা একদষ্টে তাঁর দিকে চেয়ে আছে।
পিটার তাড়াতাড়ি গলির ভিতরে ঢুকে পড়লেন।
সম্প্রতি পিটারের সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে। টাকা-পয়সার খুবই টানাটানি। কী যে করবেন ভেবে কুল পাচ্ছেন না কিছু।
সেদিন সকালে হঠাৎ ওঁর এক বন্ধু এসে হাজির।
চা খেতে খেতে পিটারের আলমারির মধ্যে ব্যাঙের মূর্তিটা দেখে সে রীতিমত চমকে উঠল। কি একটা দামী পুরানো ব্যাঙটির বেচা-কেনার ব্যবসায়ে সে বেশ খেঁপে উঠেছে।
মূর্তিটা দেখে বন্ধু বললে, ‘আমার বলতে হবে ওটা বিখ্যাত আমলের ভাস্কর্য এবং এর দাম এখন দু’ হাজার পাউন্ড।’
হাসি হাসলেন পিটার। ‘আমার কাছে দাম নিয়েছে আট পেনি। তা ভাই তুমি নিলে আমাকে দু’ হাজার পাউন্ড পাঠিয়ে দিও।’
আশ্চর্য। এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁর বন্ধুর কাছ থেকে সত্যিই দু’হাজার পাউন্ডের একটা ড্রাফট পেলেন। আর পিটারের মনে হল, এই সব টাকা তাঁর একলার নয়। কিছু উইলটনের প্রাপ্য।
মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দোকানে এসে হাজির।
‘আসুন আসুন’ উইলটন তাঁকে সাদর আহ্বান জানালেন, ‘বলুন আপনার জন্য আমি কী করতে পারি।’
পিটার সে রাত্রের সমস্ত ঘটনা তাঁর কাছে খুলে বললেন।
অবাক্ চোখে উইলটন সব শুনলেন। তারপর বললেন, কলেজের ফাইনাল পরীক্ষার জন্য তিনি পনেরো দিন দোকান বন্ধ রেখেছিলেন। তিনি ও জিনিস বিক্রি করতেই পারেন না। পিটার নিশ্চয়ই ভুল করেছেন।
‘না আমি ভুল করিনি।’ জোর গলায় বললেন পিটার, ‘এই দোকান থেকে আমি কিনেছি। যিনি বেচেছেন তাঁকে অস্পষ্ট দেখেছি।’
‘ছবি দেখলে চিনতে পারবেন?’
‘পারবো।’
উইলটন ড্রয়ার থেকে একটা অ্যালবাম বার করে পিটারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এর মধ্যে আমাদের আত্মীয়ের ছবি আছে। বার করুন তো, কে আপনাকে দরজা খুলে দিয়ে জিনিস বেচেছে?’
পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একসময় থেমে গিয়ে বললেন পিটার, ‘এই সেই লোক। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, এই সেই লোক।’
ছবিটার দিকে চেয়ে উইলটনের চোখের পাতা ক্রমশঃ ভারী হয়ে এল। দু’এক ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে।
‘কে ইনি।’
‘আমার বাবা।’ ভেজা গলায় বললেন উইলটন, ‘আজ দশ বছর আগে তিনি মারা গেছেন। এই কিউরিও শপ তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন।’
ঠিক এমনি সময় বাইরে থেকে একটা ঝোড়ো হাওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দরজাটা কখন খুলে গেছে ওরা জানতেই পারেনি। এবার দেখা গেলো দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ক্লীক!