[:bn]মনোরঞ্জন গড়াই
আমরা দেশবন্ধু রোডে থাকি। আমাদের পাড়ায় প্রতি বছর খুব জাঁকজমক করেই দুর্গাপুজো হয়। আমাদের ক্লাবের ছোটো, বড় সকল সদস্যের মতামত ও ভোটাভুটির পর পুজোর বাজেট, থিম ইত্যাদি সবকিছু ঠিক করা হয়।
বেশ কয়েক বছর প্রতিবেশী ‘সুরুচি সংঘ’ আমাদের টেক্কা দিয়েছে ঠাকুর, প্যান্ডেল, আল্ ভিড় ইত্যাদি কোনোটাতেই আমরা ওদের ধারে-কাছেও যেতে পারিনি। তাই কয়েক বছর থেকে আমাদের ক্লাবের অর্থাৎ সবার প্রিয় আমরা আর সকল সদস্যের মন মোটেও ভাল নেই।
এবারের পুজোর জন্য তাই মাসকয়েক বাকি থাকতেই ক্লাবের মিটিঁর-এর দিন ধার্য হল এবং বলা হলো প্রত্যেকেই যেন অবশ্যই সেই মিটিং- এ উপস্থিত থাকেন।
আমাদের ক্লাবের সেক্রেটারি মোনাদা বললেন, শোনো বন্ধুরা, আমরা অনেক হেরেছি, কিন্তু আর নয়। এবার আমাদের সেরার মুকুট পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতেই হবে। সামনের রবিবার বিকেল চারটেয় সকলের মিটিং-এ উপস্থিত থাকবেন এবং আশা করি প্রত্যেকেই এ-কদিন পূজোর বাজেট, প্রতিমা, থিম ইত্যাদি ভেবে নিজস্ব মতামত দেবেন।
রোববার চলে এলো। আমাদের ক্লাবের হলঘরে বিকেল চারটের সময় বসল গোপন মিটিয়ে।
মোনাদা বললেন প্রতিবারের মতো এবারেও আমরা জমায়েত হতে পেরেছি এটা খুব আনন্দের কথা। পুজো এখনো বেশ দূরে থাকলেও এখন থেকেই আমাদের লেগে পড়তে হবে নচেৎ... । যাক গে এবার সকলেই নিজের মতামত... । পূজার প্রতিমা, প্যান্ডেল, আলো ইত্যাদি নিয়ে সকলের মতামত নেওয়া হল এবং ঠিকও হয়ে গেল।
অমিয় জেঠু বললেন, সব ই তো ঠিক হল, কিন্তু এত করেও কি আমরা ওদের টেক্কা দিতে পারব। নতুনত্ব তো কিছুই দেখছিনা।
আমাদের ছোটদের মধ্যে সন্টা খুব ডানপিঠে এবং পেটে পেটে বুদ্ধি ধরে। সন্টা বললো আমার মাথায় একটা আইডিয়া... ।
নবীনদা বললেন, তাড়াতাড়ি বইল্যা ফ্যাল, তোর আইডিয়া... ।
আচ্ছা মাটির প্রতিমার অনতিদূরে জীবন্ত প্রতিমা মানে লাইভ ঠাকুর করলে কেমন হয়?
আমাদের মানে ছোটদের নেতা সন্টার এই আইডিয়াটা বড়রা লুফে নিল।
সোনাদা বলল, বা-বা–আ, স- ন্টা–আ–আ বে–বে–ড়ে-এ
আই-ডি-য়া-আ দি-য়ে-এ-ছি-স তো-ও, এবা-র-র বা-বা-ছা-রা-আ টে-এ-র-র পা-আ-বে-এ……হে- হে-হে……
মোনাদা বললেন, শোনো ছোট বন্ধুরা, সত্যিই তোমাদের আইডিয়া দারুণ, কিন্তু এর জন্য এখন থেকেই প্র্যাকটিস করতে হবে।
তমালকাকুর উপর ভার পড়ল কাকে কোন চরিত্রে সাজাবেন। সণ্টার ডানপিটেপনার জন্য ওকে অসুর ছাড়া ভাবার উপায় ছিল না। ছোটা ভিম দেখে লাড্ডুর ভক্ত হওয়া মোটা দীপ হল গণেশ, গোলগাল মুখের পিয়ালিকে সাজানো হলো মা দুর্গা। এভাবে টিয়া হল লক্ষ্মী, পাপিয়া হল সরস্বতী, সিনেমার পোকা বুল্টু হল কার্তিক আর হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে ভয় পাইয়ে দেওয়া সোনু হল সিংহ। আমি এবং বাকি বন্ধুরা থাকলাম দেখাশোনায়।
পুজোর দু'মাস আগে থেকে জীবন্ত প্রতিমার রিহার্সাল শুরু হল। যারা জীবন্ত প্রতিমা সাজবে তারা প্রথমে ব্যাপারটায় বেশ মজা পেয়েছিল। কিন্তু এবার তারা বুঝল এতে মজার চেয়ে সাজাই বেশি। কারণ ঘন্টার পর ঘণ্টা একভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। মশা কামড়ালেও চুল কুনো যাবে না। হাসির কথায় হাসা যাবে না। ক্ষিদে পেলে ও খাবার চাওয়া যাবে না।
দেখতে দেখতে পুজো চলে এল। আমাদের ক্লাবের জীবন্ত প্রতিমা দেখার জন্য মণ্ডপে ভিড় সামলানো দায়। স্বভাবতই ক্লাবের বড়-ছোট সকলেই বেশ খুশি।
সপ্তমীর দিন থেকেই জেলার সাংবাদিক থেকে প্রচুর দর্শনার্থী এসেছেন আমাদের পুজো ও জীবন্ত প্রতিমা দেখতে। প্রায় বিনা ঝামেলায় সপ্তমীর দিনটা কেটে গেল। অষ্টমীর দিন সকালেই আমরা খবর পেলাম এবার আমরা জেলার সেরা হয়েছি। ব্যাস আনন্দে আমরা ফেটে পড়লাম।
অষ্টমীর দিনটাও বিনা ঝামেলায় কেটে গেল। যদিও নবমীর দিন সকালে গণেশ অর্থাৎ দীপের নাকে মশা ঢুকে যাওয়ায় ও জোরে হেঁচে ফেলেছিল। ফলে ওর (গণেশের) শুঁড়-টুড় খুলে গিয়ে সে এক বিতিকিচ্ছিরি কান্ড। আর বিকালে মঞ্চে একটি নেংটি ইঁদুর ঢুকে পড়ায় গণেশসহ সকলে ত্রাহি ত্রাহি রবে চিৎকার করে উঠেছিল। ওদের চিৎকার শুনে মনে হচ্ছিল যেন দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের ঘোর যুদ্ধ বেধে গিয়েছে।
আজ দশমী। সকাল থেকেই ধীরে ধীরে মনখারাপটা বাড়ছে। কারণ কাল থেকেই আবার সেই বই,খাতা,কলম ইত্যাদির মধ্যে নিবিষ্ট হতে হবে।
তবুও এই তিনদিন যারা জীবন্ত প্রতিমা সেজেছে তাদের যেন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। ওদের চোখ- মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে আজকের দিনটা পেরোলে ওরা বেঁচে যায়।
বিকেল চারটে। সকলের মন খারাপ। তবু আমাদের মণ্ডপে ভালই ভিড়। আমি দাঁড়িয়ে আছি মণ্ডপের সামনে। পাঁচটার সময় মণ্ডপ অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেল।
হঠাৎ ভালো করে গণেশ ঠাকুরের সামনের থালার দিকে তাকাতেই তাজ্জব বনে গেলাম। লাড্ডুগুলো প্রায় শেষের মুখে। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পরই ধরা পড়ল ব্যাপারটা।
আমাদের গনেশ বাবাজী( আসলে দীপ) একটার পর একটা লাড্ডু খেয়ে চলেছে।
ওকে বারণ করতে যাব এমন সময় ও একটা গোটা লাড্ডু গেলার চেষ্টা করল। কিন্তু একমাত্র ছোটা ভীম ছাড়া ক'জনেই বা তাতে সফল হয়েছে তোমরাই বলো?
লাড্ডুটা দীপের গলায় আটকে গেল আর ও বিষম খেল। দীপের জলের তেষ্টা তো ছিলই, উপরি বিষম খাওয়াতে সে কোনও মতে বো-অ-অ করে চিৎকার করার চেষ্টা করল।
দীপ আসলে বোতলের জল চাইছিল কিন্তু বাকিরা মনে করল বোম-এর কথা আর তাই দীপের চাপা চিৎকারে পিয়ালি (দুর্গা) মহিষাসুরের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে সিংহ(চিৎকার করে ভয় পাইয়ে দেওয়া সোনু) প্রচন্ড জোরে বো-ও-ম...বো-ও-অ-ও-ম বলে চিৎকার করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে কার্তিক(বুল্টু) চিৎপটাং আর মঞ্চস্থলে বোমাতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। যে যেদিকে পারল ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করতে লাগল এবং পালানোর চেষ্টা করতে লাগল।
সকলের চিৎকার- চেঁচামেচি আর বোমাতঙ্কের খবর শুনে মোড়ে প্রহরারত পুলিশগুলি মঞ্চে আসার বদলে থানায় ফোন করে নিজেদের কর্তব্য সারল।
আমি কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলাম। তাই ভয় না পেয়ে অমিয়জেঠুর কাছে গেলাম। ভাগ্যিস অমিয়জেঠুর যন্ত্রটি লাগানো ছিল না। তাই কানে কম শোনা অমিয়জেঠুকে যন্ত্রটি লাগাতে বলে আসল ব্যাপারটা খুলে বললাম। জীবন্ত প্রতিমাদের অবস্থা শুনে ‘এই কে আছিস রে’ বলে তিনি এমন হুংকার ছাড়লেন যে লাইভ ঠাকুরদের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। একটু পরেই সাইরেন বাজাতে বাজাতে পুলিশ
জিপ চলে এল । জিপ থেকে বোম স্কোয়াডের লোকসহ দারোগাবাবু নামলেন । অমিয়জেঠু ওঁদের দিকে এগিয়ে গিয়ে ব্যাপারটা হাল্কা করার চেষ্টা করলেন ।
তারপর সবকিছু ধীরে ধীরে বোধগম্য হলে ঠাকুরমশাই দিবাকর চাটু্জ্যে গণেশ দীপের কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ।
কিন্তু দু'কদম এগোতেই অমিয়জেঠু বললেন, ঠাকুরমশাই ওকে ছেড়ে দিন। গণেশ বাবাজী আজ পর্যন্ত কোনো মন্ডপের প্রসাদ গ্রহণ করেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই, কিন্তু আমরা কি সৌভাগ্যবান দেখুন জ্যান্ত গণেশ কিনা স্বহস্তে আমাদের দেওয়া মিষ্টান্ন(লাড্ডু) গ্রহণ করলেন।
জেঠুর কথা শুনে সকলেই হো হো করে হেসে উঠল। মা দুর্গার দিকে তাকিয়ে মনে হল তিনিও যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন।[:]