[:bn]ড. সিদ্ধার্থ গঙ্গোপাধ্যায়
আপনার মগজের একটা বিরাট ক্ষমতা হল স্মরণশক্তি। শুধু বাঁচা নয়, জীবনের চলার পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যেটা ভীষণভাবে দায়ী। যুগ যুগ ধরে দার্শনিক আর মনোবিদেরা এটাকে নিয়ে ঘাঁটছেন। খুঁজে চলেছেন স্মৃতি মগজের কোথায় সঞ্চিত থাকে সেই অঞ্চলগুলো। আধুনিক যুগে আবার তাঁদের সঙ্গে এসে জড়ো হয়েছেন কম্পিউটার বিজ্ঞানী এবং তথ্য-প্রযুক্তিবিদেরা।
কিন্তু এঁদের সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে এলেন মস্তিষ্ক-গবেষক আর স্নায়ু বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বললেন ‘স্মৃতি’ বলে কোনো একটা বিশেষ জিনিস নেই এবং এটা আমাদের মগজের একটি, দুটি কি তিনটি বিশেষ কোনো অঞ্চলে থাকে না। মগজের কোনো কো্নো অঞ্চলে সঞ্চিত থাকে নাম-ধাম, ঘটন্ ফোন নম্বর, গাড়ি বা মোটর সাইকেলের নম্বর, বাসের- ট্রেনের বা ফ্লাইটের নম্বর। আবার কোনো কো্নো অঞ্চল সঞ্চয় করে পদ্ধতি এবং প্রণালীর বিবরণী- একটা কাজ। কী করতে হবে... যেটা মনে করে সেই অনুযায়ী কাজটা করলে আপনি কাজটা সম্পন্ন করতে পারবেন। একটা সরল উদাহরণঃ আপনি গাড়ি চালানো শিখলেন। কোন মডেলের কোন মেকের বা ব্র্যান্ডের গাড়িতে শিখলেন, তার নম্বর কত ছিল, কার কাছে শিখলেন তার নাম, কবে থেকে কবে পর্যন্ত শিখলেন সেই সময় সীমা রাখা হয়েছে আপনার মগজে্র কোন এক জায়গায়। কিন্তু গাড়িটা কি করে চালাবেন, কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে চালাবেন। কোনও বিপদের সম্ভাবনা দেখলে কিভাবে সামাল দেবেন... এইগুলো রাখা হয়েছে রয়েছে আপনারই মগজ এর অন্য কোন জায়গায়।
কোন কোন স্মৃতি স্বল্পস্থায়ী, আবার কোন কোন স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী। স্বল্পস্থায়ী স্মৃতির দৌর হল পাঁচটা থেকে বড়জোর নটা দশটা সংখ্যা অক্ষর- যেমন থাকে সেলফোনে বা পিন কোডে। এখনকার কম্পিউটারাইজড ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর যেগুলো বারো, তেরো কি চোদ্দ ডিজিটেরও হচ্ছে সেগুলোকে আর বিদঘুটে খিচুড়ির মতো প্যান নম্বর যারা মনে রাখতে পারে তারা সত্যিই বাহাদুর। একবার স্মৃতিতে গেঁথে গেলে যে-কোন তথ্য বরাবরের জন্য রয়ে যায়। কিন্তু সে তথ্যগুলোর কাছে কেহতাহে পাঠানো যায়, সেটাই আমরা ভুলে যাই।
দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতির সঙ্গে আমাদের মৌলিক কিছু আবেগ আর উত্তেজনা এবং ঘ্রাণশক্তির হাত ধরাধরির সম্পর্ক। বিশাল এক লাইব্রেরীর তাকে সাজানোর বিভিন্ন বিষয়ের ফাইল বা বইগুলোর মতো আমাদের দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিও বিষয় হিসেবে সাজানো থাকে। তবে মগজের বিভিন্ন স্মৃতি-বিভাগের মধ্যে সবসময়েই যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন থাকছে এবং আদান-প্রদান চলছে। ক্লাস টুয়েলভ ছাত্রী শ্রীমন্তী মিত্রর বুকে কফ জমে শ্বাসকষ্ট হওয়াতে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হতে হয়েছিল। সেখানে ভিক্স ভেপোরাবের (vicks vaporub) গন্ধ তাকে একেবারে ছোটবেলার স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়- সেই সময়কার যখন তার মা তার মাথা কনকন করলে কপালে ভিক্স ভেপোরাব লাগিয়ে মালিশ করে দিতেন।
স্মৃতিশক্তি সম্বন্ধে আলোচনা করার মতো অনেক কিছু আছে। এখানে কয়েকটা জরুরী তথ্য আপনাদের কাছে তুলে ধরছি।
আমাদের মনের অবস্থা অনুযায়ী স্মৃতিটা জাগ্রত হয়। যেমন- যে মনে করছে রয়েছে সুখ আর আনন্দ, সেখানেই সহজেই জেগে ওঠে সুখের স্মৃতি, আনন্দের স্মৃতি আর যে- মনে দুঃখ ভরা, সেখানে স্বভাবতই দুঃখের আর কষ্টের স্মৃতিগুলো চট করে জাগে।
প্রথমবারের অভিজ্ঞতাটা মনে গেঁথে যায় কারণ প্রথমবার আমরা প্রচন্ড মন দিয়ে দেখি, শুনি- সব অনুধাবন করি অবচেতনভাবে অবস্থাটা অনুকুল না প্রতিকুল যাচাই করার উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারে আমরা অতটা মনঃসংযোগ করি না যদি প্রথমবারে মনে হয়ে থাকে অবস্থাটা বা মানুষটার মধ্যে প্রতিকূলতা নেই। আমাদের মগজ সেদিক থেকে নিজস্ব ক্ষমতা খরচ করার ব্যাপারটা ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন।
কোন কিছু দেখার পর চোখ বন্ধ করলেই পুরো দৃশ্যটা যাদের চোখের সামনে মনের পর্দায় স্পষ্ট এবং পরিষ্কার ভেসে ওঠে এবং অনেকদিন ধরে স্মৃতিতে থাকে, তারাই ফোটোগ্রাফিক মেমোরি বা ক্যামেরার মত স্মৃতি শক্তির মালিক। প্রতি একশোতে একজনের এই ধরণের ক্ষমতা থাকে।
একজন বিদেশী ডাক্তারের কাছ থেকে একটি অল্পবয়সী ছেলের স্মৃতিশক্তি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা শোনার সুযোগ হয়েছিল। ছেলেটি ঘোড়ায় চড়া শেখার সময় হঠাৎ ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পায় এবং অজ্ঞান হয়ে যায়। তার যখন জ্ঞান ফিরে এলো তখন সেই অতি সাধারণ ছেলেটির মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন এসে গেছে সে হয়ে গেছে। সে হয়ে গেছে একটা অতি আশ্চর্য ফোটোগ্রাফিক স্মৃতিশক্তির মালিক। সে যা যা দেখছে, সব খুঁটিনাটি ছবিই উঠে গিয়ে তার মগজের অ্যালবামে রাখা হয়ে যাচ্ছে। এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তার স্মরণশক্তি টা এখন কাজ করছে যে তার মগজ এর সম্পূর্ণ ক্ষমতা ঐ কাজের জন্যই খরচ হয়ে যাচ্ছে, অন্য কোন কাজের জন্য আর কিছু অবশিষ্ট থাকছে না। একদিকে যে সে যেমন একটা অসাধারণ শক্তির অধিকারী। অন্যদিকে সাধারণ বুদ্ধির ক্ষেত্রে সে একেবারে নিঃস্ব, কপর্দকহীন। এর থেকে আমরা কি শিখলাম? একদিক থেকে কারোর মগজে যদি কোনো বিশেষ ক্ষমতার উদয় হয়, তাহলে অন্যদিক থেকে তার অন্য কোন ক্ষমতাকে হারাতে হয়।
প্রতি একশো জনের মধ্যে সাধারণ স্মৃতির অধিকারী যে নিরানব্বই জন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ কারোর মুখের ছবি মনে রাখতে পারে না... এমনকি আপনার জন, আত্মীয়-স্বজনই এবং নামী মানুষদেরও। যদিও পরীক্ষা করলে তাদের চামড়ায় বৈদ্যুতিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় - যেটা স্নায়ু ব্যবস্থার সক্রিয়তার একটা পরিমাপ এবং একটা প্রত্যক্ষ প্রমাণ যে স্মৃতির ভান্ডারে মুখের ছবিটা রাখা রয়েছে... কিন্তু কোন বিশেষ দুর্বলতার জন্য তারা সেটাকে মনে রাখতে পারছে না।
স্নায়ু বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের স্মৃতিশক্তির অবস্থান মগজের যেসব অঞ্চলে, সেগুলো হলোঃ হিপোক্যামপাস (hippocampus)- লাতিন ভাষায় যে শব্দটির অর্থ হল ‘সামুদ্রিক ঘোড়া’- ইংরেজি ‘S’ আকারের একটা যন্ত্রাংশ যেটা মগজ এর বাঁ ও ডান দিকেই রয়েছে: কর্টেক্স (cortex) যেটা আমাদের মগজে কুঞ্চিত আচ্ছাদন এবং উচ্চ মানের চিন্তার উৎসবিশেষ: আর, সেরিবেলাম (cerebellum) যেটা মাথার খুলির পিছনের দিকে ফুলকপির মত দেখতে একটা অংশবিশেষ- বাঁ মগজ ডান মগজ দুটো ভাগেই রয়েছে। (১ নম্বর চিত্রে দেখুন)
নতুন কোন তথ্য উত্তেজকের আকারে আমাদের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মগজে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই সেটা হিপোক্যাম্পাসে পৌঁছয় এবং সে ওই তথ্যের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সেটাকে সরাসরি অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়। এই অন্য কোথাও- এর অর্থ হলো আমাদের মগজে যও।–এক হাজার কোটি স্নায়ুকোষ বর্তমান, তাদের প্রত্যেকটি কিন্তু কোনো- না- কোনো বিশেষ স্মৃতি বা স্মৃতিগুচ্ছ কে ধরে রাখার জন্য দায়ী।
আমরা মাঝে মাঝেই চাবিটা কোথায় রেখেছি বা ঐ ধরনের টুকরো কোন জরুরী তথ্য মনে করতে পারিনা কেন? এটা হয় তখনই যখন বা যদি আমাদের চাবিটা কে রাখার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা না থাকে। একটা বিশেষ জায়গায় যদি চাবি রাখার অভ্যাস থাকে, তাহলে ভুলে যাবার সম্ভাবনা খুবই কম কারণ চাবির কথা মনে হলেই হাতটা যন্ত্রচালিতের মত একটা বিশেষ জায়গার দিকে এগিয়ে যায়।
স্মৃতির গঠনের পেছনে আমাদের জিনের অবদান রয়েছে নিশ্চয়ই, তা নইলে কোন কোন জিনিসের স্মৃতি দীর্ঘস্থায়্ আবার কোনো -কোনোটা স্বল্পস্থায়ী হয় -আবার সেই স্বল্পস্থায়ীগুলোর মধ্যেও কোনো কোনোটা ক্ষণস্থায়ী হয় কেন। বাইরের উত্তেজক কোন কোন জিনকে উদ্দীপিত করে অন্য কোন কোন জিনকে বন্ধ করে দিয়ে বা বন্ধ রেখে যার ফলে নিউরন (neuron) অর্থাৎ মগজের স্নায়ু কোষের মধ্যে পরিবর্তন আসে। এবং স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী হয়। জিন তো আমাদের শরীরের ব্লু-ত্রিণের আধার। তাহলে মনের নকশাও তারা ধারণ করতে পারবে না কেন?
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তি যদিও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে শুরু করে, সবাইকে তো আর অ্যালঝাইমার(Alzheimer) রোগ পাকড়াও করে না। পঁয়ষট্টি বছরের বেশি যাদের বয়স তাদের প্রতি একশো জনের মধ্যে সাতজনকে এই রোগ ধরে।
মদ্যপানে নেশাগ্রস্থ যারা তাদের ক্ষেত্রে যে স্মৃতিশক্তি লোপ পায়, সে-ধরনের সমস্যা ও সবার ক্ষেত্রে দেখা যায় না।[:]