শঙ্করের চোখের সামনে বিভিন্ন বাড়ির গৃহদেবতার মূর্তি ভেসে উঠলো। প্রতিটা ঠাকুরঘরে দামি দামি কাঁসা-পিতলে বাসন। প্রণামীর সোনার মোহর, রুপোর টাকা, কত বছর ধরে দেবতাকে মানত করে দেওয়া অলংকার, সব এক মুহূর্তে মনে পড়ে গেল। কত ছোটবেলা থেকে ঠাকুর্দা -বাবার হাত ধরে বাড়িগুলোতে গিয়েছে । বাবা পূজো করলে সে পাশে থেকেছে বা সাহায্য করেছে। আজও যজমানেরা তাকে বিশ্বাস করে। বাপ-ঠাকুর্দার উত্তরাধিকারী বলে বাড়তি মনোযোগ দেয়। কিন্তু লোভ এমন জিনিস কখন যে তার ছায়া আস্তে আস্তে মানুষকে গ্রাস করে ফেলে তা সে নিজেও বুঝতে পারে না। নানা কুযুক্তি খাড়া সে নিজের আচরণকে সমর্থন করতে থাকে।
শঙ্করেরও ঠিক সেই অবস্থায় হলো। সে ভাবল দেবতা তো মাটির, পাথরের তৈরি। গয়না, টাকা, বা মোহর কি তারা ভোগ করতে পারে? এ শুধু মানুষের কল্পনা । মানুষ দেবতাকে দামি জিনিস নিবেদন করে এসেছে বছরের পর বছর । কেউ সে সব খুলেও দেখে না। কারও কোনো কাজে লাগে না। যাদের উপচে পড়া বাড়তি টাকা আছে তারাই দেবতাকে নিবেদন করে দামি জিনিস। এসব চিন্তা করার পর শঙ্করের মনে আর কোনো পাপবোধ রইল না। সে তার নিজের মনকে বোঝালো -- আমিও দেবতার সেবা করে এসেছি এত বছর। তার উপযুক্ত দক্ষিণা হিসেবে এর কিছুটা দাবী করতেই পারি।
এরপর তিন মূর্তির অভিযান শুরু হল। শঙ্করের থেকে খোঁজ খবর পেয়ে রজত ও খোকন সুযোগ বুঝে হাজির হয়ে মুহূর্তের মধ্যে কাজ সেরে হাওয়া হয়ে যায় । কয়েকমাসের মধ্যে উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়ির ঠাকুরঘরগুলোতে পরপর হানা দিয়ে এরা বেশ ভালোরকম কামিয়ে নিল।
প্রতিবছর দোলপূর্ণিমাতে নিস্তারিণী দেবী ঘটা করে রাধা-মাধবের পুজো দেন। সেইজন্য শঙ্কর একটু সকাল সকালই এসেছিল। ঠাকুরঘরে ঢোকা মাত্র শঙ্করের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কৃষ্ণের হাতের সুন্দর কারুকাজ করা বাঁশিটি পাক্কা দশ ভরি হবে। কালো কষ্টি পাথরের মূর্তির হাতে সোনার বাঁশিটি যেন এক্ষুনি বেজে উঠবে বলে মনে হচ্ছে। শঙ্কর নিস্তারিণীকে ইচ্ছে করে বলল, এত দামী জিনিস পুজো শেষে তুলে রাখাই ভালো। নিস্তারিণী হেসে বললেন ,না বাবা, রাধা-মাধবের জন্য করিয়েছি সিন্দুকে তুলে রাখব কেন? যাঁর জিনিস তিনিই রক্ষা করবেন।
শংকর শুনে মনে মনে বেশ খুশি হলো। একটু বুদ্ধি খাটালেই এবাড়ির ঠাকুর ঘরে ঢোকা এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়। ঠাকুর ঘরের পাশে রাস্তার ধারের বারান্দার গায়ে একসারি জানালা। তিনতলা বলে তাতে কোনো গারদও নেই। সব কটা জানালা খুলে দিলে রোদ , আলো-হাওয়ায় ঠাকুর ঘর ভেসে যায়। দরকার না হলে জানালাগুলো খোলা হয়না। কোনো এক রাতে কিছু ফেলে গেছি এই ছুতোয় যদি ঠাকুর ঘরে ঢোকে আর বারান্দার কোন একটা জানালার ছিট্কিনি খুলে চলে যায় তাহলে রজতরা খুব সহজেই কাজ হাসিল করতে পারবে। রাস্তা থেকে তিনতলা পর্যন্ত ওঠা ওদের কাছে জলভাত ।
সেদিন রাতে শঙ্কর বাবাকে স্বপ্নে দেখল। বাবা বলছেন, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু, এখনো সময় আছে, ফিরে আয়। বাবার পাশে ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, মা আরও কত চেনা অচেনা মৃত আত্মীয় পরিজন পূর্বপুরুষের মুখ । স্থির হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলে চলেছেন, ফিরে আয় ফিরে আয়। ঘেমে নেয়ে গলা শুকিয়ে শঙ্করের ঘুম ভেঙ্গে গেল। জল খেয়ে ধাতস্ত হয়ে মনে হলো ভাগ্যিস, এটা স্বপ্ন। কেন যে সে এত ভয় পেয়ে গেছিল কে জানে? হয়ত অন্য বার শুধু খোঁজখবর দিয়ে দেয়, এবার নিজে উপস্থিত থেকে অংশ নেবে তার জন্য মনের ভেতর গোপনে একটা ভয়, একটা অস্থিরতা দানা বাঁধছে।হয়তো নিস্তারিণী এত স্নেহ করেন বলেই একটু বিবেকদংশনও হচ্ছে। শঙ্কর গামছায় মুখ মুছে সমস্ত ভাবনা চিন্তা গুলোকে ঝেটিয়ে বিদায় করল। একবার যখন শুরু হয়ে গেছে তখন ফিরে আসার কোন মানে হয়না। নাচতে নেবে কি কেউ ঘোমটা দেয় ?
ঠিক পরের আমাবস্যায় একটু রাত করে শঙ্কর নিস্তারিণীর বাড়িতে গিয়ে হাজির হল। সমস্ত পাড়া নিঝুম। হু হু করে বসন্তের বাতাস বইছে। শঙ্করের গলা শুকিয়ে উঠেছে। হাতের তালু ঠান্ডা ভিজে ভিজে -- ঠিক জ্বর আসার আগে যেমন হয়। নিস্তারিণী ও তাঁর মেয়ে সবে রাতের খাওয়া সেরে উঠেছেন, শঙ্কর গিয়ে কড়া নাড়ল ------খুব খারাপ লাগছে এত রাতে আপনাদের বিরক্ত করতে। ঠাকুরঘরে গীতাটা ফেলে গেছি। ছাতাটাও বারান্দার কোনে রেখেছিলাম । ওখানেই পড়ে আছে। ছাতা না হলেও চলত কিন্তু খুব ভোরে গীতাপাঠ আছে সেজন্য বাধ্য হয়ে আপনাদের বিরক্ত করতে হল। মেয়ে সত্যিসত্যি বিরক্ত হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, নিস্তারিণী তাকে থামিয়ে বললেন, তাতে কী হয়েছে,এ তো তোমার নিজেরই ঘরবাড়ি। এই যে চাবি, যাও নিয়ে এসো গিয়ে তোমার জিনিস । তিনতলার কার্নিশে দিকে তখন অন্ধকারে মিশে এগোচ্ছে দুই মূর্তি ---- রজত আর খোকন । শঙ্কর জানে বেশি দেরি করা চলবে না। ঠাকুরঘরের তালাটা আলগা রেখে, বারান্দার একটা জানলার ছিটকিনি খুলে নেমে যেতে হবে। মা মেয়ে দোতলাতে শোয় । তিনতলা খালি থাকে। ওরা একবার ঢুকে পড়তে পারলে আর ভয় নেই। তালা খুলে ঠাকুর ঘরে ঢুকেই শঙ্কর অবাক হয়ে গেলো। বাইরে অন্ধকার ঘুটঘুট করছে অথচ পূর্ণিমার চাঁদের মত আলোয় সমস্ত ঘর ভরে আছে । সে মুগ্ধ হয়ে এই অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করে করল খানিকক্ষণ। তারপর কি জন্য এসেছে সেটা হঠাৎ মনে পড়ায় পেতলের ঘড়ার আড়ালে রাখা গীতাটা তুলে যেই বেরোতে যাবে অমনি বাঁশিতে সুর বেজে উঠল। সে পিছন ফিরে দেখে পাথরের কৃষ্ণঠাকুর জীবন্ত হয়ে সোনার বাঁশিটি বাজিয়েই চলেছে । শঙ্কর তাকাতেই চারচোখে মিলন হল। সেই পাথরের চোখ দিয়ে স্নেহ -করুনা ঝরে পড়ছে, যেন বলছে, তুই পালাবি কোথায়? বাঁশির মায়াময় সুরে শংকর যেন ছোবল মারতে ভুলে যাওয়া এক সম্মোহিত সাপ। আবছা করে মনে পড়ছে, তার যেন কি করার কথা? কারা যেন তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কি যে করার কথা কারা বলেছিল কিছুই আর মনে পড়ল না। রজত ও খোকন এদিকে এক মারাত্মক বিপজ্জনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে। শঙ্কর ভেতরে গিয়েছে অনেক্ষন,ছিটকিনি খোলার নামগন্ধও নেই। এখন বাইরে থেকে জানালা ভাঙার প্রশ্নই ওঠে না। সেই প্রস্তুতিও নেই। এতক্ষন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে লোকের চোখ পড়তে বাধ্য। হলও তাই। পুলিশের একটা টহলদার গাড়ির জোরালো আলো আসে পড়ল তাদের গায়ে। তার সঙ্গে তীক্ষ্ন বাঁশির আওয়াজ । আর পালাবার উপায় নেই। এদিকে ঠাকুরঘরে শঙ্কর এক অদ্ভুত মায়াময় সুরের জালে বন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । খানিক বাদে তার মনে হল এই জগত - সংসার সবই অলীক মায়া। তার ঘরবাড়ি নেই। সংসার নেই। কেউ কোথাও নেই। তার যুক্তি বুদ্ধি সব গুলিয়ে গেল। প্রাণভোলা বাঁশির সুর কানে নিয়ে শঙ্কর ভূতে পাওয়া লোকের মতো নিচে নেমে এল । নিস্তারিণী ও তার মেয়ে কি যেন বলছেন। রাস্তায় অনেক লোক। শঙ্কর শূন্য চোখে তাকিয়ে দেখল। তার মাথায় কিছুই ঢুকল না কারণ তার সমস্ত কান জুড়ে আছে সেই সোনার বাঁশির সর্বনাশা মন ভুলানো সুর। শঙ্কর সেই যে পথে বেরিয়ে এলো তার আর ঘরে ফেরা হলো না কোনদিন। গঙ্গার ঘাটে উসকোখুসকো চুল একটা লোক দিন রাত বিড়বিড় করে বকে আর নতুন লোক দেখলেই জিজ্ঞেস করে শুনতে পাচ্ছ? এটাই যে একসময় পূজারী ব্রাহ্মণ শঙ্কর ছিল তা আর বোঝার উপায় নেই।ঋতা বসু
[:]Copyright © 2024 Dev Sahitya Kutir Pvt. Ltd. All rights Reserved
Design & Developed By SR SOLUTIONS