[:bn](বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত স্মৃতি-সাহিত্য প্রতিযোগিতায় ৩য় পুরস্কৃত গল্প )
আগামী বুধবার দশে পা দেবে রুন্মি। বাড়িতে সাজো সাজো রব। মা- বাবা তো আছেনই, দাদু -ঠাকুমা সকলেই ওর জন্মদিন নিয়ে অতুৎসাহী। প্রতিবছরই ওর জন্মদিনে একটা গ্র্যান্ড সেলিব্রেশন হয়। পাড়ার সমস্ত লোকের বাড়িতে গিয়ে নেমন্তন্ন করে আসেন মা আর ঠাকুমা মিলে। সকলেই রুন্মির জন্মদিনটার কথা মনে রাখে আর ঐদিন বাড়ি ছেড়ে কেউ কোথাও যায় না। এত সুন্দর অনুষ্ঠান হয় যে কোনভাবেই মিস করার নয়। জলপাইগুড়ির বহু মানুষ আসেন সেদিন। দাদু নামকরা উকিল ছিলেন, সেই সুবাদে পরিচিতও অনেক।
শুধু এবার একটাই দুঃখ। বাবা কোন জোগাড়যন্ত্র করতে পারছেন না। ছ'মাস আগে বাবা বদলি হয়ে গেছেন বাকুড়ায়। আর সেদিনের পর থেকে তার সঙ্গে শুধু একবারই দেখা হয়েছে রুন্মির। মেয়ে অন্ত প্রাণ বাবা। একটা মাত্র মেয়ের কোনও অভাব রাখেন না তিনি। মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই হাজির হয়ে যায় সব কিছু। ঘর ভর্তি খেলার জিনিস। কত রকমের যে বার্বি ,রাপুঞ্জেল ,সিন্ড্রেলার টয় সেট ,ভিডিও গেমস,ফেয়ারি টেলস -এ ওর ঘর ভর্তি তা শুনে শেষ করা যাবে না। প্রতিদিন রাতে বাবার সঙ্গে মেয়ের ফোনে কথা হয়। বাবা বলেছেন,ওর জন্মদিনের দিন সকালে আসবেন। ওর যা যা পছন্দ সব লিস্ট করে রাখতে, ওদিন পৌঁছেই ওকে সঙ্গে নিয়ে সব কিনে দেবেন।
রুন্মি খুবই খুশি। আসলে মেয়েটি খুবই গুণী। পড়াশুনো, ছবি আঁকা, সাঁতার সবেতেই ভালো করেছে। সবার প্রশংসা পাচ্ছে। গর্বে মায়ের বুকটা ভরে যায়। ওকে তো স্কুলের দিদিমণিরা ভীষণ ভালবাসে। এইটুকু বসে কত্ত প্রাইজ পেয়েছে। তবে একটি মাত্র মেয়ে তো, সবকিছু একাই পেয়েছে। যা চেয়েছে সবই দিয়েছেন মা বাবা দাদু । না চাইতে সব পেয়ে মেয়ে খারাপ হয়ে যাবে না তো !
বাবা অবশ্য রুন্মির মায়ের কথায় গুরুত্ব দেন না। বলেন, আমার একটাই মাত্র মেয়ে, চাইলে পৃথিবী এনে দেবো ওর হাতে। ছোটবেলায় একমাত্র বোন কে হারিয়েছি ওই আমার সন্তান হয়ে ফিরে এসেছে আমাদের কাছে। ওর চোখে এক ফোঁটা জল আসতে দেব না আমি, কিছুতেই না।
ঘুমন্ত মেয়ের মাথায় একটা আলতো চুমু খেয়ে ওর পাশে শুয়ে পড়লেন রুন্মির মা। কাল অনেক কাজ। সকাল সকাল উঠতে হবে। এক রত্তি মেয়েটা দশ বছরে পড়বে বলে কথা ! বাবার কথামত মেয়েও লিস্ট রেডি করে চলেছে, শুধু কাল বাবা এলেই আবার গাদা গুচ্ছের খেলনা, চকলেট, গেম্স্ দিয়ে ঘর ভরবে সেনবাড়ির।
আমার সোনা মা, জন্মদিনের অনেক অনেক ভালোবাসা, আশীর্বাদ উজার করে দিলাম তোর জন্য তুই অনেক বড় হ ,মানুষের মত মানুষ হ ! ভোরের ট্রেনে রুন্মির বাবা চলে এলেন। বাবা মেয়েতে কত্ত আদর, কত্ত খুনসুটি চলল কিছুক্ষন। এদিকে ক্যারিয়ারের লোকজন চলে এসেছে কখন , নিচের উঠানে ইয়া বড় বড় কড়াইতে রান্না হচ্ছে কত কিছু,বেশিরভাগই রুন্মির পছন্দের খাবার। বিরাট একটা দোতলা কেকের অর্ডার করেছেন দাদু কেকেস এন্ড বেকড থেকে । সমস্ত ডেকোরেশন হবে রূপকথার প্রাসাদের মতো। লোকজন আসতে শুরু করবে আর কিছুক্ষণ বাদেই। রুন্মি ওর বাবার সঙ্গে বেরিয়েছে লিস্ট নিয়ে। লিস্টটা বাবাকে দেয়নি। ও একটা একটা করে বলবে আর বাবা সেখানে ড্রাইভ করে নিয়ে যাবেন, এটাই শর্ত। মেয়ের হুকুম বলে কথা !
প্রথমেই খেলনার দোকান থেকে প্রচুর খেলনা আর চকলেট কিনল সে। তারপর চলল বইয়ের দোকানে। সেখান থেকেও নানা ধরনের বই কিনল, সবগুলোই পড়াশুনোর। বাবা তো খুব খুশী, মেয়ে জন্মদিনে পড়ার বই কিনছে বলে। এবার বাবাকে নিয়ে চলল শহর ছাড়িয়ে। বাবা বলছেন,কোথায় যাব বল মা । রুন্মি বলছে ,চল না আর একটু !
জলপাইগুড়ি শহর থেকে চার -পাঁচ কিলোমিটার দূরে পৌঁছে যেখানে চা বাগান শুরু হল, সেখানে দাড়াতে বলল রুন্মি। বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'এখান থেকে কি কিনবে তুমি? রাস্তা ঠিক বলেছ তো ?'
বাবাকে হাত ধরে টানতে টানতে রুন্মি এগিয়ে গেল ভেতরে, গাড়ির থেকে প্যাকেটগুলো নিল সঙ্গে। বাবা কিছু বুঝতে পারছেন না এখনও। একটা বন্ধ চা বাগানের ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে নিয়ে গেল ঝুপড়ি বাড়িগুলোর পাশে। ওকে দেখেই একটা ওর বয়সী মেয়ে হাসিমুখে দৌড়ে এল। রুন্মি ওকে ধরে বলল, হ্যাপি বার্থডে সীমা ! বলে ওর হাতে ধরে থাকা প্যাকেটগুলো ওকে দিল । মেয়েটির চোখ দুটো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এত নিষ্পাপ দুটি কিশোরী মেয়ের দু জোড়া চোখের অভিব্যক্তি সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে দেখছেন রুন্মির বাবা। কখন যে নিজের অজান্তেই তার চোখ দুটো ভিজে গেল বুঝতেই পারলেন না তিনি।
চলে আসার সময় রুন্মি বাবাকে বলল, আমার জন্মদিনে এটাই এত দিনের সেরা গিফট বাবা। আমার তো সব আছে আর কিছু চাওয়ার নেই। কিন্তু সীমার জন্মদিন কবে নিজেই জানত না তাই আমি ওকে বলেছি এখন থেকে আমার জন্মদিনের দিন ওর জন্মদিন হবে। ও আমাদের স্কুলের পাশে রোজ আসে ওর বাবার সঙ্গে। বাবা চোখে দেখে না,ও ধরে ধরে নিয়ে আসে ,আর বাদাম বিক্রি করে তারপর। আমার খুব কষ্ট হয় ওর জন্য। ওর বাবা যে বাগানে কাজ করতো সেটা এখন বন্ধ, কত কষ্ট করে ওদের দিন চলে। আমি কিছু চাই না বাবা, তুমি ওদের জন্য কিছু কর।'
একরত্তি মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে আনন্দে ভাষা হারিয়ে ফেলেন পিনাকীবাবু। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রমিস করলেন,তিনি এখন থেকে সীমার পরিবারের সব দায়িত্ব ওঁদের । একই দিনে প্রতিবছর ওরও জন্মদিন পালন করবেন। সত্যিই তো , মেয়ে এরকম একটা কথা ভাবতে পারে এই বয়সে, ওঁরা প্রত্যেকেই কেন পারেন না একটা করে দুঃস্থ পরিবারের দায়িত্ব নিতে ! কত বাজে খরচ হয় এটা-সেটায় , তার চেয়ে ভালো কাজের পেছনে এইটুকু করা গেলে শান্তি আসবে সকলের জীবনে। ঈশ্বরলাভ এতেই তো হয়। কথা আছে না, 'জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর !'